মিতিনমাসি সমগ্র - সুচিত্রা ভট্টাচার্য | Mitinmashi Shomogro

চীনের মিং রাজবংশের আমলে তৈরী চীনের প্রাচীরের নাম শুনেনি এমন মানুষ পাওয়া যাবে না। এই মিং রাজবংশ প্রতিষ্ঠার ১০০ বছর পর এক বিখ্যাত অভিযাত্রীর জন্ম হয়, নাম মা-সান-পাও। ইতিহাসে তাঁকে আমরা চিনি অ্যাডমিরাল জেং নামে। হঠাৎ করেই রাজা ইয়ং-লো একদিন তাঁকে হুকুম দেন।

" তোমাকে আর যুদ্ধটুদ্ধ করতে হবে না,তুমি চিনের প্রতিনিধি হয়ে দেশে দেশে ঘোরো, আর পারলে নতুন নতুন জায়গা খুঁজে বার করো।" মিতিনমাসি সমগ্র - সুচিত্রা ভট্টাচার্য 

রাজার হুকুমে ১৪০৫ সালে অ্যাডমিরাল জেং বেরিয়ে পড়েন নৌঅভিযানে। ১৪২১ সালে পৌঁছে গেলেন আমেরিকায়, কলম্বাস তখনো জন্মগ্রহণই করেননি। গভীর সমুদ্রের বুকে প্রকান্ড নৌকার পাটাতনে দাঁড়িয়ে আছেন জেং আর তার পাশে বসে মিং ডাইনেস্টির বিখ্যাত শিল্পী মো-ই-টং আঁকলেন পৃথিবীর প্রথম অথেন্টিক মানচিত্র। সমুদ্র অভিযান শেষে জেং যখন দেশে ফিরলেন, কুপরামর্শে প্ররোচিত হয়ে নতুন রাজা হুংশি নৌযাত্রার সব কাগজ,নথিপত্র জ্বালিয়ে দিলেন। কিন্তু মো ছিলেন ধুরন্ধর, বিপদের গন্ধ পেয়ে আগে ভাগে সরিয়ে ফেলেছিলেন ম্যাপটা।কালের বিবর্তনে ম্যাপটি এসে পড়লো ভারতের দক্ষিণ পরগনার বজবজে এক নামকরা বাঙালি ডাক্তারের কাছে। কিন্তু মো কি জানতেন প্রায় ৬০০ বছর পর এই ম্যাপের জন্য প্রাণ দিতে হবে এক গবেষককে? তথ্যসূত্র: ঝাও ঝিয়েন হত্যা রহস্য।

কাহিনি সংক্ষেপ

টেরিবাজারের চিনা স্কুলে ইতিহাস পড়াতেন ঝাও ঝিয়েন। মেধাবী ছাত্র হওয়ায় সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে গ্রাজুয়েশন করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিস্ট্রিতে ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে এম এ পাশ করেন। অনেক ভাল চাকুরির সুযোগ থাকলেও স্কুলের টানে সেখানেই থেকে যান। স্কুলে পড়ানোর পাশাপাশি চিনা সংস্কৃতি ও ইতিহাস নিয়ে তার প্রবল আগ্রহ ছিল। ইউরোপিয়ানরা চিনাদের সম্পর্কে যে অসম্পূর্ন ও আংশিক ভুল ইতিহাস লিখেছে সেটার জন্য গবেষণা করে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ একদিন বেকবাগান মোড়ের কিউরিও শপে একটি ওয়ালহ্যাঙ্গিং দেখেন। কয়েকবার চেষ্টা করেও কিউরিও শপের মালিক স্বপনবাবু পারিবারিক স্মৃতির টানে কাপড়ের টুকরাটি বেচতে চাইলেন না। তবে শেষ পর্যন্ত টাকার নেশায় হ্যাঙ্গিংটা বেচে দেন ঝিয়েনের কাছে। দুপুরবেলা হ্যাঙ্গিংটা কিনে সেদিনই সন্ধ্যায় গাড়ি চাপা পড়ে মারা যান ঝিয়েন। ঝিয়েন অত্যন্ত সাবধানী ও অজাতশত্রু মানুষ হওয়ায় তার ভাইপোর সন্দেহ জাগে। সামান্য একটা ওয়ালহ্যাঙ্গিং কেনার জন্য নিতান্তই নিরীহ একটা মানুষকে দুনিয়া থেকেই সরে যেতে হল? কী এমন বিশেষত্ব থাকতে পারে এক ফালি কাপড়ের টুকরায়, যাতে কিনা ইতিহাস বদলে যাবে?

লেখিকা পরিচিতি

লেখিকা খুব রক্ষণশীল বনেদি পরিবারের মেয়ে ছিলেন। জ‍্যাঠামশাই (বাবার বড় ভাই) করুণা ভট্টাচার্য ছিলেন মোহনবাগান ক্লাবের বিখ‍্যাত ফুটবলার এবং ডাকসাইটে কর্মকর্তা। মাত্র সতেরো বছর বয়সে পালিয়ে বিয়ে করলে,মেয়ের দুঃসাহস দেখে বাবা বাড়ি থেকে এক প্রকার বের করে দেন। আর্থিক সংকটে সংসার জীবন শুরু হলো দারিদ্রের সাথে লড়াই করে।আর একটা অদ্ভুত স্বভাব ছিল তাঁর। বিয়ের পর থেকেই কিছু বান্ধবীর সাথে গিয়ে প্রত্যেক দিন শ্মশানে বসে থাকতেন। জীবন মৃত্যুকে দেখতেন কাছ থেকে। উঁচু পোস্টের সিভিল সার্ভিস চাকরি পেয়েও ছেড়ে দিয়ে পরবর্তীতে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন।

পাঠপ্রতিক্রিয়া

লেখিকার গল্প বলার ধরন বেশ আলাদা। সাদামাটা ভাবে লেখা কাহিনি হলেও তাতে সূক্ষ্ম হিউমার মিশ্রিত ছিল। একাই একশো গোয়েন্দা চরিত্র বানানোর কোনো চেষ্টা করেননি যেটা অবশ্যই প্রশংসা করার মত। গোয়েন্দাদের বুদ্ধিদীপ্ত ইমেজ ফুটিয়ে তুলেছেন প্রজ্ঞাপারমিতা (মিতিন মাসি) নামের একটি মেয়ে চরিত্রের মাধ্যমে। মিতিন মাসি পড়ার সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে এটা কিশোর পাঠকদের জন্য লেখা হয়েছে। জটিল রহস্য ও প্রথাগত তদন্তের মিশেল এখানে খুঁজে পাবেন না। বুদ্ধি আর যুক্তিতর্কের খেলায় উঠে আসবে দেশবিদেশের নানান জায়গা, জাতি, ধর্ম ও সমাজের আলোকে রচিত রহস্য কাহিনি।

★"ঝাও ঝিয়েন হত্যারহস্য" উপন্যাসের শুরু ঝাও ঝিয়েনের অপমৃত্যুর ঘটনা দিয়ে। ঝিয়েনের ভাইপো লিয়াংয়ের খটকা লাগায় সে তার বন্ধু কুশলকে বলে। পরবর্তীতে কুশলের মাধ্যমে তার পাড়ার বন্ধু টুপুরের কাছে আসে মিতিন মাসির সাহায্য নিতে। উপন্যাসের প্রথম এক-তৃতীয়াংশে টুপুর কুশলকে নিয়ে একাই গোয়েন্দাগিরি চালিয়ে যায়।

★উপন্যাসের পরবর্তী দুই তৃতীয়াংশের পুরোটা জুড়ে ছিল মিতিন মাসির নেতৃত্বে পর্যায়ক্রমে করা তদন্তের বর্ণনা, সরেজমিনে গিয়ে জিজ্ঞাবাদ ও ফ্যাক্টসগুলা যোগ বিয়োগ করে ঘটনার সত্যতা জানার চেষ্টা।

★পাঁচ জন সাসপেক্টের ভিতর সবচেয়ে শক্ত জেরার মুখোমুখি হন স্বপনবাবু এবং সবচেয়ে কম তরুণবাবু। তরুণবাবুর সাথে কথোপকথনের অংশটুকু লেখিকা কৌশলে এড়িয়ে গেছেন। সেটা কারোর কাছে কাহিনির দূর্বলতা মনে হতে পারে, আবার রহস্যের জাল বিস্তারের জন্যও হতে পারে।

★পুরো উপন্যাসে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট ও মোবাইল কলের লোকেশন ট্র্যাকিং ছাড়া বাকি সবটুকুই টুপুর,কুশলসহ পরিবারের কয়েকজনের আলোচনা ও মিতিন মাসির বুদ্ধির চাল, যুক্তিতর্কে অপরাধীকে ফাঁদে ফেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ।

★ রহস্য উপন্যাসের প্লট নির্বাচন সহজ হলেও কাহিনির বিস্তার ও যুক্তিসঙ্গত পরিনতি দেয়া এতটা সহজ নয়।"ঝাও ঝিয়েন হত্যা রহস্য" উপন্যাসের প্লট দারুণ। হলুদ পুরানো এক টুকরো কাপড়ের জন্য পৃথিবীর ইতিহাস পাল্টে যেতে পারে। কিন্তু ঘটনা প্রবাহের সাথে সাথে রহস্যের জট খুলেছে সরলরৈখিকভাবে। ছোটখাট কোনো টুইস্টতো ছিলই না, সামান্যতম সাসপেন্সের দেখাও মিলেনি। সাসপেক্টদের সাথে দেখা করার সময় যেগুলা তৈরী করা যেতো খুব সহজেই। পুরো উপন্যাসটা শুধু ঝরঝরে লেখনশৈলীর জন্য উৎরে গেছে।

চরিত্রকথন

ঝাও ঝিয়েনঃ ৪৭ বছর বয়সী চিনা স্কুল শিক্ষক।টেরিবাজারের চিনা স্কুলে হিস্ট্রি পড়াতেন আর চিনের অপ্রকাশিত ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতেন।


মিতিনমাসি: পুরো নাম প্রজ্ঞাপারমিতা মুখোপাধ্যায় ওরফে মিতিন মাসি। অপরাধ বিজ্ঞান, ফরেনসিক সাইন্স, অপরাধ মনস্তত্ব, নানা রকমের অস্ত্রশস্ত্রের খুঁটিনাটি, এনাটমি, ফিজিওলজি, নানা রকমের আইনের বই, বহু কিছু নিয়েই চর্চা করেন মিতিন। গল্পে তার আবির্ভাব একটু দেরিতে হলেও পরবর্তী পুরো কাহিনি দাপিয়ে বেড়িয়েছেন।

টুপুর: মিতিনের বোনঝি। ভাল নাম ঐন্দ্রিলা।মিতিনের সহকারী হিসেবে গল্পে তার বেশ শক্ত ভূমিকা আছে। ঝাও ঝিয়েন কেসের শুরুর কাজটুকু সে নিজেই সামাল দেয়।

কুশল: টুপুরের পাড়ার বন্ধু। এলাকার মোড়ের হলুদ বাড়িতে থাকে। গল্পে তদন্ত করার সময়ে সহযোগী হিসেবেও দেখা যাবে তাকে।
লিয়াং: কুশলের ক্লাসমেট। ঝিয়েনের ভাইপো। ছোটখাটো চেহারার লিয়াং মধ্য কলকাতার ছাতাওয়ালা গলিতে থাকে। টুপুরকে তুপুর নামে ডাকে।

মেইলি: লিয়াংয়ের ছোট বোন। ভারি মিস্টি আর পুতুলের মত দেখতে। হ্যাঙ্গিং সম্পর্কে তার বলা একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্লু ছিল__"ইতিহাসের পাতায় আবার ফু শাংয়ের নাম ফিরে আসবে।"
স্বপনবাবু (সাসপেক্ট ১):গ্র্যান্ড কিউরিও শপের মালিক। রেসের নেশায় আসক্ত মধ্যবয়সী ব্যক্তি।পারিবারিকসূত্রে ওয়ালহ্যাঙ্গিংয়ের প্রাক্তন মালিক।গল্পে তার চরিত্রায়ন ভাল ছিলো। *( কিউরিও শপ হচ্ছে দূর্লভ ঐতিহাসিক জিনিস পত্রের দোকান)
ডক্টর বাসব (সাসপেক্ট ২): কালো গাট্টাগোট্টা আর চোখে মোটা চশমা পরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কর্কশ হলেও ঠান্ডা মাথার মানুষ। মিতিন মাসির সন্দেহের তালিকার একদম উপরে আছেন উনি।

ডক্টর তরুণ (সাসপেক্ট ৩): মেথডিক্যাল,অ্যাম্বিশাস ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ।ওয়ালহ্যাঙ্গিংয়ের অস্তিত্ব এবং চিনাদের অন্তর্দন্দে খুন হবার বিষয়ে প্রথম মতামত দেন তিনি। সবচেয়ে দূর্বলভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে তাকে।

ডক্টর শিবতোষ (সাসপেক্ট ৪): বড়জোর বছর পঞ্চাশের ভদ্র, রুচিশীল মানুষ। সিমলাইপাড়ায় একনামে সবাই তাকে চিনে। ঝিয়েনের গবেষণা ও ম্যাপ সম্পর্কিত সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য জানা যায় তার থেকে। সন্দেহের তালিকায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র তিনি।

মন্টু (সাসপেক্ট ৫): কিউরিও শপে কাজ করে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়।

সম্পাদনাঃ লেখিকা অর্থোডক্স বনেদী পরিবারের মেয়ে হওয়ায় তাঁর লেখায় খাস উত্তর কলকাতার কিছু শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন:ডেঁপোমি,ল্যাংবোট,ফ‍্যাচাং ইত‍্যাদি। এমন শব্দের জন্য এপার বাংলার মানুষজন বেশ মজা পাবে। পুরো উপন্যাসে বানান ভুল খুঁজতে গিয়ে কানা হবার দশা। ওপার বাংলার বইয়ের কি অসাধারণ সম্পাদনা হয় সেটার আরেকটা নমুনা বইটি।

রেটিংঃ ৩ / ৫
১.০ কেটেছি প্লটের দূর্বল এক্সিকিউশনের জন্য
০.৫ তদন্ত প্রক্রিয়ার জন্য
০.৫ টুইস্ট ও সাসপেন্সের অভাবে

উপসংহার

গোয়েন্দা কাহিনির সৌন্দর্য তার রহস্যে। কাহিনির ঘনঘটা যত তীব্র হবে, ততই রহস্যভেদের মজা বাড়বে। রহস্যের জাল বোনা আর ধীরে ধীরে সেই জাল কাটিম সুতার মত আসতে ধীরে ছেড়ে গোয়েন্দা কাহিনিগুলোর বাঁকবদল আমাদের চমকে দেয়। এমন কাহিনি ফাঁদার জন্য লেখিকা বিস্তর পড়াশোনা করে গল্প লিখেছেন এটা বলতেই হবে। তবে "ঝাও ঝিয়েন হত্যা রহস্য" পড়ে মজা পাবেন যদি চিন সম্পর্কে জানার আগ্রহ থাকে। আর নাহলে এত সুন্দর প্লটের এক্সিকিউশন বেশ দূর্বল লেগেছে আমার কাছে। গল্পের সবচেয়ে স্মার্ট চরিত্র তরুণবাবুর স্বরে বললে, "ফালতু স্টোরি শোনার আমার সময় নেই। যত্তসব আষাঢ়ে কল্পনা!"


Tags : bangla tutorial,bangla current affairs,rgj bangla,how to convert word to pdf bangla,pdf,word to pdf,bangla book pdf,hs bangla mcq pdf,hs bangla saq pdf,bangla word to pdf,ms word to pdf bangla,bangla question pdf,bangla pdf book download,quran shikkha bangla pdf,bangla movie,crate pdf file in bangla,bangla cartoon,how to make pdf file bangla,pdf convert bangla tutorial,bangla book pdf free download,bangla,bangla word file to pdf converter, bangla pdf book download,bangla book pdf free download,pdf,bangla book pdf,bangla,bangla tutorial,bangla current affairs,hs bengali question paper 2022 pdf download,class 11 bengali question 2022 pdf download,how to download bangla book pdf free,r s agarwal gs bangla pdf download exam guruji,r s agarwal general science bangla pdf download,how to convert word to pdf bangla,free download,how to download free pdf bangla and english book,download bangla board boi

Next Post Previous Post