হিজল বনের গল্প - আনান বিনতে আলম

আমাদের পাশের বাড়ির টুকটুকির আজ বিয়ে। গড়নে-বরণে যে ডাগর হয়েছে, গ্রামবাসীর সেদিক ভেবে রেহাই নেই যেন, মানে ছিল না আরকি এতদিন…! আজ তো বিয়ে হয়েই যাচ্ছে।


‘আজ্ঞে মাস্টারমশাই তা আমাদের টুকটুকির বে শাদি দিবেন কবে? তা বললে আমিই ঘটকালি করি নাকি? যুগ জামানা ভালো না মাস্টার সাহেব বে শাদি দিয়ে দিন।’

‘আমাদের টুকটুকির পড়ার দিক খুব টান, বুঝলে আনারুল। এই দেখো এই বইয়ের গাট্টিটাও তার। চুড়ি ফিতা না, মেয়ে আমার ফিরবার পথে বই আনতে বলে, দেখেছো? দিবো তো বটেই তবে আরেকটু মেয়েটা বুঝুক। সবে এন্টারটা পাশ করল।’

‘হাতের এবার এর পাত্রটা বেশ খাসা। মাশাআল্লাহ মাশাআল্লাহ যেমন চওড়া ছাতি তেমনি জাত পাত! মাল্টিনেশনাল না বায়িং হাউজ কী বলে যেন বড় পদে চাকরি মাস্টার সাহেএএএব! শুনেছি ওদের বংশের হাত বেশ বড়! সদরের প্রায় সব মাদ্রাসায় বড় বড় অংকের দান এর পর্চাটা তাদের নামেই কাটে। আমাদের টুকটুকি মা কে পড়াতে আপত্তি করবে বলে মনে হয় না! আর বুঝোই তো শিক্ষিত মানুষদের বড় বড় কারাবার, ভেবে দেখো! বে টাও হলো তোমার মায়ের বই পড়ার শখটাও। আর সুখে যে থাকবে খুব…তা আর বলতে…হাহ হাহ হা, মাস্টার সাহেব!’

আনারুল চাচার পান খাওয়া দাতের ফিক করে হাসি আর এই প্রশ্ন জসিম মাস্টারকে ঘিরে রাখত যেন। 

জসিম মাস্টার যাকে স্যার ডাকি…হ্যাঁ টুকটুকির বাবা! আমাদের স্কুলেরই স্যার ছিলেন। 

গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছি বহুদিন। সেদিন ফোন করেছি,
মা শখ করে বললেন,

‘বাবা জানিস টুকটুকির বিয়ে!’
‘কী! টুকটুকি?’
‘হ্যাঁ রে, মাস্টার মশাই কতবার বলেছেন তোর কথা, বাবা! আয় না! ২ বছর হয়ে আসছে কত দিন হলো এ গ্রামের ধুলো মাড়াসনি! এবার ঘুরে যা…! বিয়েটারও নেমন্তন্ন রাখা হয়ে যাবে।’

‘আজ্ঞে, হ্যাঁ মা।’

‘বাবা আসবার সময় ভালো দেখে একটা কাপ-পিরিচের সেট আনিস তো! আমাদের এদিক তো সব ম্যালামাইন! কাচের আনবি শহর থেকে কেমন? তোর মনে আছে? আমাদের পুকুর পাড়টার কাঁঠাল তলায় টুকটুকি খেলত তার মিছামিছি সংসার। হাহাহা…আমার চুলো বানাবার মাটির ঢিপিটা থেকে যে কত মাটি চুরি করেছে সে! তার পুতুলের বিয়ের জন্য খাবার রাঁধবে তার হাঁড়ি বানাতে! সেই বকুনি দিয়েছিলাম। আজ সেই টুকটুকি মায়ের সত্যি বিয়ে…দেখেছিস! আনবি কিন্তু বাবা! হ্যাঁ?’

‘হ্যাঁ মা।’

হ্যাঁ মা তো বলি, কিন্তু আমার বুকের বাঁ দিক টায় কেমন যেন হু হু করে ওঠে। এই তো সেবার দেখে এলাম খেলছিল। ধুপ করে এত বড় হলো! সেবারটা অবশ্য বহুদিন! এবার শুনছি ওর বিয়ে! সময় কতটা দ্রুত চলে যায়!

টিকিটটা আমাদের মেস ক্যাশিয়ার সজীবকে দিয়ে কাটিয়ে রাখলাম। সকাল ৭টায় ট্রেন আসবে। কাকভোর আমার অনেক দিন হলো দেখা হয়ে ওঠে না! ফযরের আযানও শোনা হয় না। গ্রামে থাকতে অবশ্য  নামায পড়া হত। সে অনেকদিন! স্টেশনে তাড়াতাড়ি যেতে হবে বলে আমি বিছানায় শুয়ে পড়লাম। নিজেও জানি না কীসের জন্য এত ছটফটানি। 

সকালে ঘুম ভাঙল লঞ্চের জোরে একটা হর্নে। আমাদের মেস পেরিয়ে কয়েক বিল্ডিং পরেই বুড়িগঙ্গা। এমন আওয়াজে কান সয়ে গিয়েছে। ততক্ষণে ৮টা ৩০! ট্রেন ছিল ৭টায়। উসাইন বোল্টের নাম আমার রুমমেট নাকি শোনেনি। তাকিয়ে দেখি সে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। একদিন কথায় কথায় জেনেছিলাম, পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুততম মানবের নাম সে নাকি জানে না! না জানাই স্বাভাবিক…।

গ্রামের হাবা গোবা একটা ছেলে, সবে শহরে পড়তে এসেছে। কিন্তু সে কী জানত বাংলাদেশের বুকে একদিনের জন্য তার রুমেই উসাইন বোল্ড এসেছিল! সে যে আর কেউ না তারই রুমমেট! যত জোড়ে দৌড় দেয়া যায় সেই দৌড়টাই দিয়েছিলাম। ব্যাগে যে আমার কাচের কাপ পিরিজ আছে সে খেয়াল মাথাতেই নেই! 

থাকুক...

হন্তদন্ত হয়ে স্টেশন গিয়েছি ভাগ্যিস ট্রেনটা সেদিন দেরি করেছিল! ইচ্ছে করছিল ট্রেন চালকের কপালে চুপু এঁকে দেই। নাহলে আমাকে রেখেই যে চলে যেত.. জানি না কীসের তাড়া। টুকটুকিরই তো বিয়ে! আগেও তো কত বিয়ে খেয়েছি... তবে চুম্বকের মত কী যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।

যখন গ্রামের মেঠোপথ ধরে এগিয়ে চলছি তখন সন্ধ্যা।  আর সেই চিরচেনা আমার গ্রামের গোধূলির আকাশ। বেশ লাগছিল! দূর থেকে টুকটুকিদের বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। শামিয়ানা টাঙানো, লাল নীল মরিচ বাতিগুলোতে বিয়ের সাজসাজ রব। গ্রামের বিয়ে....বাচ্চাদের ছুটোছুটিতে মুখোর। কাল তার বিয়ে। আমি এত দিন পর গ্রামে এসে ঝিঁঝিঁর ডাকে বুদ হলাম। আমাদের খাড়া টিনের চালের ঘরের জানালা দিয়ে জোৎস্না ঘরের মেঝেতে পড়ছে। ক্লান্তি বা তাড়া দুটোই ভুলে গেলাম।

বাড়ি গিয়ে কবজি ডুবিয়ে মায়ের হাতের অমৃত রান্না খেলাম। আহ! কতদিন পর যেন তৃপ্তি! ততক্ষণে টুকটুকির বিয়ের কথা আমি বেমালুম ভুলে গিয়েছি। খাওয়া শেষে আব্বা আম্মার স্বাস্থ্য আর আমার পড়াশোনা  এসব নিয়ে তাদের সাথে, আর চাচা দাদী ভাই বোনগুলো সবার সাথে একটু গল্প করেই বিছানায় এলিয়ে দিলাম শরীর। ঘুমে বেহুশ। সকাল হতে না হতেই পাখির কিচিরমিচির শব্দ আর মাটির কেমন যেন ঘ্রাণ বাতাসে। উঠলাম।  বাসি বিছানায় তখনো ভাবলাম, পুরাতন সব বন্ধুদের সাথে দেখা করতে হবে হাতে তো ছুটিই নেই! এই আসাই আসা! কবে আর আসা হয়...ভাবলাম দুপুরে খাবারটা খেয়েই ওদের সাথে দেখা করব।

"আজ তো দুপুরেই ওর বিয়ে। ওহ হো! মায়ের সাথেই তো যেতে হবে। স্যারের সাথেও দেখা করব। স্যারের পুরাতন আরো ছাত্ররাও আসবে নিশ্চয়। বিয়ের কথা ভাবলাম আবার রক্তে শিরদাঁড়া বেয়ে কী যেন একটা বয়ে গেল। " কেন যে এমন জানি না।

মায়ের সাথে বিয়ে বাড়ির গেট অব্দি এসে  দেখি সবার অন্ধকার চেহারা আর ফিসফিসানি কানাঘুষা চলছে কেমন যেন। বিয়ে বাড়ি কেন জানি হঠাৎ একদম নিরব! কালই তো দেখলাম  সরব! আজ ওমন অন্ধকার কেন। কী ব্যাপার?

ভেতর থেকে হালকা চেঁচামেচির আওয়াজ আসছে। রুম পেরিয়ে মেয়েদের মহল হতে আওয়াজ বাইরেও শোনা যাচ্ছে এখন। ঘটনা কী? আওয়াজ আরো জোরে  হচ্ছে-

"না না আমরা পর্দাশীল মেয়ে চেয়েছি। তাই বলে এত পর্দাশীল কাউকে চাইনি তো! এমন গোড়া ধর্মান্ধ ! শুনেছিলাম মেয়ে ধার্মিক আমরাও ওমন কাউকেই চেয়েছি নামায রোযা করে, বাইরে গেলে একটু আধটু বরখা পড়ে, বড়দের সমীহ করে, অনুষ্ঠানাদিতে একটু মান রাখে। ব্যাস! আমাদেরও তো মেয়ে আছে কই বিয়ের সময় তো এমন করেনি!! কিন্তু এখন তো দেখছি এ পুরোই গোড়া! স্বামীর বড় ভাইকেও নাকি সে মুখ দেখাবে না। আর এসব কী?? কোনো পুরুষকে রুমে ঢুকতে দিবে না। এখন এতো মানলে হয় নাকি!!  আমরাও তো দেবুর ভাসুরের সামনেই সংসার করেছি। বাচ্চা মানুষ করেছি। এগুলো  কী?  কেউ বিয়েতে পড়ে নাকি বরখা।  

আমাদের বংশ কত বড়... এত এত আত্মীয়রা এসেছে আমার ছেলের বউ দেখবে বলে, সাজ দেখবে বলে। গহনাগুলো কী এমনিই বানিয়ে দিলাম??! আর মেয়ে কী এসব পড়ে আছে। খুলোহ!..."

ধমকটা একটু জোড়েই হয়। কথাতে বুঝতে পারি এ বুঝি টুকটুকির হবু শাশুড়ী।  দুই হাত ভর্তি সোনার চুড়ি ঝাকিয়ে কথা গুলো বলছেন,

"না না বেয়ান। আপনাদের মেয়ে যে এমন আমি তো জানতাম না।  আপনারাও তো বলেননি। আমরা ধার্মিক মেয়ে চেয়েছি কিন্তু এমন না। বড় বড় ঘরের মেয়ের অভাব ছিল না কিন্তু আমার ছেলে আমার পছন্দে বিয়ে করবে বলে আমি আপনাদের ঘরে সম্বন্ধ করেছি। আপনারা সম্মানিত পরিবার ভেবেই। আমার ছেলেও তো নামায পড়ে! আমরাও তো হাজি পরিবার।  কই আমরা তো এত গোড়ামী করি না। আর এসব গোড়ামী সে একদম পছন্দ করে না! আমাদের বংশের সম্মান আছে না একটা!! তার ৫০ জনের মতো তো বন্ধুই বাইরে বসা তাদের হবু ভাবীকে দেখবে বলে। একটা সামাজিকতা আছে না বেয়ান! এমন হলে কীভাবে চলবে। এত একগুঁয়ে... সেই তখন থেকে বলছি। এভাবে হলে তো বিয়ে আগানো যাবেনা।"

আমি টুকটুকির দিক তাকিয়ে অবাক! এই কী সেই আমাদের টুকটুকি? চোখ দুটো ছাড়া কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না তাও মাথা নিচু করে। শরীরটা কালো আবরণে ঢাকা। কাঁদছে না হাসছে কে জানে! মনে হলো সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ এর মাঝে শান্ত শীতল নিজের সিদ্ধান্তে  এক অটল পাহাড় সে।  এবার একটা লোক এলো। হয়ত টুকটুকির মামা হবে! চড় থাপ্পড় দেবে এমন উপক্রম।

"আচ্ছা তুই কী শুরু করেছিস বল তো, তুই কী মান সম্মান খোয়াবী আমাদের!! শুনছিস উনি কী বলছেন?? বিয়েই ভেঙে দিবেন উনার মত না শুনলে। আর তুই কবে থেকে ওমন হলি। এসব আলখাল্লা পড়বার আগে নিজের বাপ মায়ের কথা শুনা ফরয(!), জানোস না। এটা খুলে শাড়িটা পড় যেমন সাজতে বলছেন সাজ।"

সবাই চুপ। সকলেই টুকটুকির উত্তরের অপেক্ষা করছে।  সব মেঘ কাটিয়ে একটা আওয়াজ,

"আমি আমার মন মত কিছুই করিনি মামা! আর করতেও পারব না।  আমি ততটুকুই করতে পারব যেটা আমার রবের বেধে দেয়া উসুল নিয়ম,  নির্দিষ্ট সীমানার বাইরে যাবে না। সাংঘর্ষিক হবে না। পর্দাশীল বউ চাওয়া সহজ, কিন্তু বিয়েতে ১০০ জনের সামনে তার আব্রুকে সম্মান করা তার মতকে সম্মান করা পর্দাশীল কাউকে রক্ষা করা কঠিন মামা! যদি উনাদের পুরুষ মেহমানরা সব আলাদা বসেন আর আমাকে আলাদা ভাবে বসানো হয় তবে আমার উনার কথা...”

কথাটা শেষ হতেই দিল না। মহিলা গমগমিয়ে বরবেশী তার ছেলেকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। লোক দিয়ে বলে পাঠালেন এ বিয়ে হবে না। যে মেয়ে বিয়ের আগেই তার কথা শোনে না বিয়ের পর তাকে ইশারায় নাচাবে বৈ কিচ্ছু না। তার দৈব কল্পনা শতভাগ সত্যি বলেই তার বিশ্বাস! মুহূর্তে বিয়ে বাড়ি ফাঁকা হল। টুকটুকির কান্নাটা এবার ফুঁপিয়ে হচ্ছে। মাস্টার সাহেব মাথায় হাত দিয়ে কোনার এক চকিতে বসে। টুকটুকির মা অবিরত কান্না করছেন।  গ্রামের মানুষরা নানান কথা বলছে। শহরে হলে এসব তুবড়ি বাজিয়ে উড়িয়ে দেয়া যেত, গ্রামে ব্যাপারটা অনেক অপমানের। একান ওকান হয়। তাও যদি হয় ইসলামকে মানার নাম মত নতুন কোনো বিষয়  তাহলে কথা থামবে না। দ্বীন পালন কথাটার সাথে সেদিনই পরিচিত হলাম।

"কেমন মেয়ে! মা বাপের দিক দেখেও সম্মানের কথা ভাবল না তাদের, দুধ কলা দিয়া কাল সাপ পুষছে। এই মাস্টারই একে মাথায় তুলছে। আজ বাপ ভাইয়ের কথাই শুনল না। ছি ছি ছি"

"এত পর্দা দেখায়। আগে কী আছিলো! জানা আছে"

"আরে দেখো কোনো চক্কর টক্কর আছে নাকি, প্রেমিক আশিকের! ওর সাথে বিয়ের জন্য হয়ত এসব নাটক। আমি তো আগেই বুঝছিলাম মাইয়ার গতি মতি ভালো না।"

"এই বিয়ে ভাঙা মেয়েকে আর কেউ বিয়ে করবে না। কার এমন হাবাগোবা কালো বস্তার মত বউ চাই"

নির্বাক টকটুকি। ফুঁপিয়ে কাঁদছে যে খুব বুঝা যাচ্ছে কিন্তু শব্দ হচ্ছে না। আমি আর মা একে অপরের দিক চাওয়া চাওয়ি করছি। কিছু না খেয়েই চলে আসলাম দুজন। দুপুরে আমাদের বাড়িতেও আর খাওয়া-দাওয়া হলো না। ফুল মতোন একটা মেয়ের সাথে এমন হল, আর টুকটুকি এত বড় কবে হলো? দ্বীনের প্রতি এত ভালোবাসা মেয়েটার কবে হলো। হা-হুতাশ পর্যন্ত করলো না। আমার নামাযের সাথে সম্পর্ক নেই। সেদিন দেখলাম নামাযের প্রতি ভালোবাসা কাকে বলে! আছরের আযান হল আস্তে করে সে সরে গিয়ে নামাযে দাড়াল। এমন মুহূর্তেও নামায!! আমার বুকে কী জানি একটা হচ্ছিল। নিজের প্রতি ঘৃণা টুকটুকির প্রতি শ্রদ্ধা। তখন সন্ধ্যা... 

শুয়েই ছিলাম। কপালে হাত দিয়ে ভাবছি তো ভাবছিই। জীবন কী? কী করেছি! আল্লাহর সামনে দাঁড়াব মানি...কিন্তু আমল করি না। কেন এত দূরে আমি!! এমন অজ পাড়া গাঁয়ে থেকেও দ্বীনের আলোয় আলোকিত যে হল আমি শহরের হাজারটা সুবিধের মধ্যে থেকেও তার আংশিক পেলাম না!! অসহ্য আত্মদহন!

রাতটা চোখের কোনায় নিজের প্রতি অনুশোচনার জলস্রোতে ডুবে কাটালাম। ১০ বছর পর আমি প্রথম সেদিন ফযরের নামাযটা পড়লাম। খুব কান্না করে দুয়া করলাম। বুকে কী সাহস আসলো জানি না। আব্বাও আমার সাথে মসজিদ থেকে ফিরছিলেন বললাম,"আব্বা কাল টুকটুকির সাথে কী ন্যায় হয়েছে কী অন্যায় হয়েছে সবটা দেখেছেন। এমন বিনা অপরাধে কেউ শাস্তি পাবে এমন অপবাদ সইবে এটা কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের কেউ মানতে পারবে না। আমাদের গ্রামের মানুষদের আপনি জানেন তারা কসুর ছাড়বে না কথা ছড়াতে। আব্বা টুকুটুকিকে আমি বিয়ে করব যদি আপনি মত দেন”

"কিন্তু বাবা টুকটুকি আর তুই কত আলাদা দেখেছিস? তুই পারবি ওর মত করে ওকে রাখতে, ও যেমন জীবন চায়?

কিছুক্ষণ চুপ থাকলাম।

২.

" আসসালামু আলাইকুম। আপনার বাসা আসা হবে কবে জানি না! আর এই চিঠিটাই বা আপনার কাছে কবে যাবে..! এই সময় এ আপনাকে পেলাম না মনটা তাই ভীষণ খারাপ। ওর দাদা কানে আযান দিয়েছে। যাই হোক এটা হয়ত কল্যাণের ছিল!

জানেন? চোখ খুলতেই দেখি পিটপিট করে গভীর মায়াবী কালো দুটি চোখ আমার দিকে তাকিয়ে। বুঝবার আগেই অদৃশ্য এক টান অনুভব করলাম তার প্রতি। সেই অনুভূতি আরো পরিষ্কার হলো যখন কোমল ছোট ছোট নরম দুটি হাত, নবমোহে গন্ধে ভরা শরীরটা আর তার মায়াবী মুখের স্পর্শ আমি আমার শরীরে পেলাম। সে যে কী এক অনুভূতি! তা বলবার না...যেন আত্মার সাথে আত্মার সম্পর্ক।   আমার নবজাতক কন্যা! আমাদের নবজাতক কন্যা! এই মাত্র পৃথিবীর কোলে সে। আশ্চর্য তার স্পর্শতে আমার সব ব্যথা যেন চলে গেল আর যখন তার কান্নার আওয়াজ পেলাম আমি জানেন কেদে দিয়েছি। আপনি হলে অবশ্য মুছে দিতেন! তার হাতগুলো ধরে রাখতেন।

তার কান্নার আওয়াজ  আমার মধ্যে একটা দায়িত্ববোধের সৃষ্টি করল। এমন এক আনন্দ আমি মা হয়েছি,  আমি মা হয়েছি একজনের! আর আপনি বাবা! আল্লাহ অদ্ভুত এক ভালোবাসার শক্তি তৈরী করেছেন মা বাবা ও সন্তানের মধ্যে।  আমাদের মেয়েটা ভারী সুন্দর হয়েছে দেখতে, কী সুন্দর তার ছলছল দুটি চোখ। মুখটার দিক তাকালে রবের প্রশংসাই করতে ইচ্ছে করে।  তার দ্বীনদারীতার জন্য দুয়া করবেন। সে যেন আমাদের চোখের শীতলতা হয়।

মা মেয়ে আমরা দুজনেই সুস্থ আছি। সামনের সপ্তাহে অবশ্যই বাড়ি আসবেন মেয়ের নাম জানিয়ে চিঠি লিখবেন। চিঠির উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম। 

ইতি 
টুকটুকি।

....
আজ আমার বয়স ৬৫।  জীবনটা দৈর্ঘ্যর হিসেবেও বড় প্রস্থের হিসেবেও বড়। অনেকটা পথ  কাটিয়ে এসেছি। সবার জীবনে এমন কেউ থাকবে যাকে কেন্দ্র করে বাচতে ইচ্ছে করবে। সেই কেন্দ্রটা ছিল টুকটুকি। এই যে চিঠিটা পড়ে আঝোরে কাঁদছি আমার টুকটুকি আমার স্ত্রীর হাতে লেখা পত্র! বিয়ে করেছিলাম ছাত্র অবস্থায়। আমাদের প্রথম বাচ্চা যখন হয় তখনও আমি ছাত্র! কিন্তু বিয়ে রিযিককে প্রশস্ত করে। পড়ছি কাঁদছি তাও আমার সামনে কাবা! সরকারি হজ্জ এজেন্সির মুয়াল্লেম আমি। প্রায় প্রতিবছর বায়তুল্লাহর সফরে আসি। কোনো দিন ভাবিনি এই খাদেম হিসেবেও আমার জীবন কাটবে। যার জন্য এমন, যে আমার কেন্দ্রটাকে আল্লাহর দিক ঘুরিয়ে দিয়েছে সেই মানুষটা আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছে বছর দেড়েক। আমরা একসাথে বৃদ্ধ হলাম। আমার বুকে তার চিঠির ওই কথাটা বাজে "যাই হোক হয়তো এটাই কল্যাণের" হুম টুকটুকি এই যে দেখো কল্যাণ! তোমার এই স্মৃতিটাকে আগলে ধরে বাঁচি!  সেই চিঠির পর আর চিঠি লেখেনি সে। 

পরপরই চাকরি পেয়ে যাই। তাকে আমার কাছে শহরে নিয়ে আসি। সুখ দুখের দাম্পত্যর ৩২ বছর পার করেছি আমরা। একে একে ৫ সন্তান। সকলেই দ্বীনদারিতায় চক্ষু শীতলকারী আলহামদুলিল্লাহ! দরদর করে পানি পড়ছে চোখ দিয়ে আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুক। এতগুলো মানুষকে বদলে দিয়েছে সে।

আমি আজ বুঝি সেদিন কেন ওমন ছুটে গিয়েছিলাম বুকটা ওমন হুহু করছিল কেন, এই সেই মানুষ যার সাথে জীবনের অর্ধ বছর কাটালাম। সেই দিন আমার সাথেই তার বিয়ে হল।  এমন না যে আমি বিয়ের পর একদম পরহেজগার হয়ে গিয়েছি নামায তো কাযাও হয়েছিল গাফেল হতাম কিন্তু তার প্রতি মুগ্ধতায়  কী যে কৌশলে সে আমার মধ্যে কীসের এক বীজ বপন করছিল দ্বীনদারিতার যা আমাকে এই বায়তুল্লাহর ঘরের খাদেম বানিয়েছে। আল্লাহর ইচ্ছা আর তার দুয়া! জীবনটা হয়ত এমনই আমরা পথ চলতে চলতে কারো পথের সঙ্গী হই কেউ আমাদের, এভাবে পথগুলো থাকে ঠিকই মানুষগুলো হারিয়ে যায়। কিছু মানুষ স্মৃতিতে আজন্ম বেঁচে থাকে, আমার কাছে টুকটুকিও তাই। ইন শা আল্লাহ আমাদের খুব শীঘ্রই দেখা হবে। আমি তাকে কিয়ামতের মাঠে উজ্জ্বল মুকুট পরিহিত দেখব আর মুগ্ধ হবো সে তো ৫ জন হাফেয হাফেযার জননী!

আজও আমাদের আঙিনায় চাঁদের আলো পড়ে, কেবল জোৎস্নার রংটা আর ধরা হয় না। পুরনো সবকিছু আছে নেই সে। হিজল বনটাও আছে কেবল নেই সে বনের গল্পের বুনিয়াদিতে থাকা মানুষটা।

~হিজল বনের গল্প
আনান বিনতে আলম

#রৌদ্রময়ী


Tags : bangla tutorial,bangla current affairs,rgj bangla,how to convert word to pdf bangla,pdf,word to pdf,bangla book pdf,hs bangla mcq pdf,hs bangla saq pdf,bangla word to pdf,ms word to pdf bangla,bangla question pdf,bangla pdf book download,quran shikkha bangla pdf,bangla movie,crate pdf file in bangla,bangla cartoon,how to make pdf file bangla,pdf convert bangla tutorial,bangla book pdf free download,bangla,bangla word file to pdf converter, bangla pdf book download,bangla book pdf free download,pdf,bangla book pdf,bangla,bangla tutorial,bangla current affairs,hs bengali question paper 2022 pdf download,class 11 bengali question 2022 pdf download,how to download bangla book pdf free,r s agarwal gs bangla pdf download exam guruji,r s agarwal general science bangla pdf download,how to convert word to pdf bangla,free download,how to download free pdf bangla and english book,download bangla board boi

Next Post Previous Post