কলকাতার কাছেই - গজেন্দ্রকুমার মিত্র

বাংলা সাহিত্যের হাতেগোনা ত্রৈয়ী উপন্যাসসমূহের মধ্যে অন্যতম। গজেন্দ্রকুমার মিত্রের এই উপন্যাস তিনটিতে উঠে এসেছে এক পরিবারের প্রায় একশ বছরের ইতিহাস, ঐ পরিবারের বিভিন্ন নারীর জীবনকে উপজীব্য করে। এই ট্রিলজির ১ম খণ্ডঃ 'কলকাতার কাছেই'


শ্যামা ঠাকরুনের বাড়ির চারপাশে এক বিঘৎ জমিও সে খালি রাখেনি। সব জায়গায় ঠেসে লাগানো গাছপালা। সূর্যের আলো পায় না বলে গাছের ফলন নেই। কিন্তু বৃদ্ধা শ্যামা তা বুঝতে চান না। মনে মনে ভগবানের কাছে অভিযোগ জানায় শুধু। ছিটগ্রস্ত এই বৃদ্ধা এখন একাকি এক বিশাল বাড়িতে বাস করেন। ছেলে মেয়ে সব দূরে। দিনের বেলায় শ্যামা পাতা কুড়ান আর রাত কাটে নির্ঘুম। রাতে সে ভাবে তার অতীত। 

শ্যামার মা রাসমনি। তার চৌদ্দ বছর বয়সে বিয়ে হয়। গঙ্গার ঘাটে রাসমনিকে দেখে এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ জমিদারের উদ্বেল হৃদয়ের ফলাফল তার বিয়ে। বৃদ্ধ জমিদার মানুষটা ভালো ছিল। তরুণী ভার্যাকে ভালবাসত। কিন্তু সে বেঁচে রইল না বেশিদিন। আর জ্ঞাতিরা রাসমনির নামে কলঙ্ক তুলে বের করে দিলো ঘর থেকে। স্বামীর ভালবাসার উপহার গয়নাগুলো সম্বল করে রাসমনি কলকাতায় এলেন। এখানেই একা হাতে মানুষ করতে শুরু করলেন তিনটি মেয়ে। কমলা,শ্যামা আর উমা। 

একা যুবতী রাসমনি বাস করেন কলকাতায়, তিনটি মেয়ে নিয়ে। কিন্তু তাই বলে তাকে গঞ্জনা খুব একটা সহ্য করতে হয়নি। কারন দুটো। প্রথমত তার ব্যক্তিত্ব, দ্বিতীয়ত পড়শিদের সাথে কখনও মিশতে যাননি। একা একাই থেকেছেন ভাড়ার বাড়িতে। বড় মেয়ে কমলাকে বিয়ে দেন। সোনার জামাই তার। মেয়ে সুখেই থাকে। এমন সময় ঘটকী আসে শ্যামার বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে। খুব একটা খোঁজ খবর না করেই শ্যামাকে বিয়ে দেন রাসমনি। 

শ্যামার গল্প শুরু হয় এখান থেকেই। কলকাতায় বসবাসকারী শ্যামা গিয়ে ওঠে এক গণ্ডগ্রামে। রাসমনি লেখাপড়া জানতেন। যেটুকু জানতেন তা দিয়েছিলেন মেয়েকেও। কিন্তু শ্যামার শ্বশুরবাড়ি তেমন না। আরও টের পেল,তার স্বামী নরেন একটা অমানুষ। ছিটগ্রস্ত এই লোকটা জানোয়ারের সমান। মাকেও সে গালাগালি করতে কসুর করে না। শাশুড়ি ক্ষমাদেবী অবশ্য শ্যামাকে মেয়ের মতই দেখেন। কিন্তু নরেনের অত্যাচারে জীবনটা বিষিয়ে যেতে শুরু করে। 
নরেন যখন তখন তার শাশুড়ির কাছে টাকা চায়, শাশুড়ির গয়নার তলব করে। সে তার গ্রামের বারো বিক্রি করে কলকাতায় যায় নতুন বাড়ি খুঁজতে। শ্যামা, ক্ষমাদেবী আর শ্যামার জা রাধারানীকে রেখে ওরা দুই ভাই যায় কলকাতায়। আর সেখানে গিয়ে বেশ্যা বাড়িতে দুই ভাই টাকা উড়িয়ে ফিরে আসে শূন্য হাতে, যৌন রোগ নিয়ে।

এরই মাঝে শ্যামার যমজ বোন উমাকে বিয়ে দেয় রাসমনি। উমার স্বামী শরৎ। সে নরেনের মত অমানুষ হয়। সুন্দর করে কথা বলে উমার সাথে। কিন্তু সে স্ত্রীর মর্যাদা দেয় না উমাকে। কেননা কলকাতায় তার এক রক্ষিতা আছে এবং সে তাকেই ভালবাসে। মায়ের জোরাজুরিতে সে বিয়ে করেছে। আর উমার শাশুড়ি চামার। সে বৌ এনেছে দাসী খাটানোর জন্য। মৃতপ্রায় উমাকে একদিন এক প্রতিবেশী নিয়ে এসে রেখে যায় রাসমনির কাছে। সেই থেকে উমা থাকে রাসমনির কাছে। সুখ শান্তি ঘুম-উমা শ্যামা আর রাসমনির জীবন থেকে বিদায় নেয়। 

জীবন থেমে থাকে না। থেমে থাকে না গল্প। একদিন নরেন তার বৌ আর ছেলেকে নিয়ে এক যজমান বাড়িতে তোলে। সে ব্রাহ্মনের ছেলে, পৈতা আছে। মন্ত্র জানুক আর না জানুক, ওতেই চলে যায়। আর ধড়িবাজ নরেনের জন্য এসব কোন ব্যপার না। বদলে যেতে থাকে শ্যামা। মায়ের কাছ থেকে পাওয়া আভিজাত্য গুড়িয়ে যেতে থাকে। জীবনের প্রয়োজনে সে হয় স্বার্থপর। কখনও চোর। 

রাসমনি সুন্দরী ছিলেন। তার রূপ পেয়েছে প্রতিটি মেয়েও। সেই রূপের ডালি আর যৌবনের ঝাঁপি নিয়ে উমা বসে আছে। শরৎ তো নরেনের মত জানোয়ার না। তবু সে কেমন মানুষ...।!! এমন বৌকে যে ঘরে নেয় না। উমা তাদের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে থাকে। রাস্তায় দৃষ্টি পাতে। যদি একবার শরতের দেখা মেলে...!!! 

গজেন্দ্রকুমার মিত্রের বই ‘কলকাতার কাছেই’। উপন্যাস নয়, বরং একটা সময়ের মানুষদের মানসিক, সামাজিক আর পারিবারিক অবস্থানের ছবি। রাসমনি আর তার পরিবারের এই গল্প শুধু তাদের একার নয়। এমন গল্প সেই সময়ে কলকাতার অনেক পরিবারে দেখা যেত। অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া, ব্রাহ্মণদের নাম-সর্বস্ব কৌলীন্য ধ্বংস করত জীবন। নষ্ট করত মানুষের সৌকুমার্য। বাঁচার জন্য বিকাতে হত আত্মসম্মান। 

রাসমনির একটা মেয়েই শুধু সুখে ছিল,কমলা। সুযোগ সুবিধা মত সে উমা-শ্যামাকে সাহায্যও করত। কিন্তু রাসমনির কপালে বুঝি কোন অভিশাপ আছে। মারা যায় কমলার স্বামী। ছেলেকে নিয়ে সে এখন একা। স্বামীর সামান্য সঞ্চয় আর নিজের গয়নাকে পুঁজি করে বেঁচে থাকার শপথ নেয় সে। 

উমাকেও বাঁচতে হবে। রূপের ডালি নিয়ে কলকাতায় একা যুবতীর বেঁচে ঢাকা বড় কঠিন। তবু তাঁকে পারতে হবে। সে সেই চেষ্টা করে। যেটুকু লেখাপড়া শিখেছিল তাঁকে পুঁজি করে মেয়ে পড়িতে কয়েকটা টাকা রোজগার করে। 

শ্যামা তার মানসিকতা বদলে ফেলেছে। বাঁচার জন্য যেকোন কিছু করতে রাজি সে। বিবেক বিসর্জন দিয়েছে অনেকটাই। বেহায়ার মত মায়ের গয়না আর বাসনে ভাগ বসায়। নরেনের স্বভাব তার মাঝেও ঢুকে গেছে। তার ছেলে হেম একটু বড় হয়েছে। সেই যজমান বাড়িতে নিয়মিত পূজা দেয়। মেয়ে মহাশ্বেতার বিয়েও দিয়ে ফেলল। মহাশ্বেতার জামাই অভয়পদ একটা অদ্ভুত মানুষ। দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করার শপথ নিয়ে জন্মেছে এই অল্পভাষী মানুষটা। 

রাসমনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সময় বুঝি শেষ। কমলার একটা সন্তান আছে, ছেলে। কমলাকে সে দেখবে। নরেন অমানুষ হলেও সে মাঝে মাঝে দেখা দেয়। শ্যামাকে মারুক তবু শ্যামা তার স্পর্শ পায়। শ্যামার ছেলেও আছে। উমা বড়ই একা। তার কেউই নেই। মা ছিল, সেও চলে যাচ্ছে। উমার কথা ভেবে রাসমনির বুক ফেটে যায়। যমের ডাকে তবু সাড়া না দিয়ে উপায় নেই। মেয়েটাকে একা রেখে যেতে হয়। কিন্তু উমা যখন শ্মশানে যাওয়ার জন্য ছুটতে থাকে, তার পাশে শরতকে দেখা যায়। 

গজেন্দ্রকুমার মিত্র দেখিয়েছেন সময়ের সাথে মানুষের বদলে যাওয়া। বেঁচে থাকার জন্য তাদের সংগ্রাম। মনের কুৎসিত দিক আর সৌকুমার্যের দ্বন্দ্ব। ‘কলকাতার কাছেই’ যে এমন কিছু ঘটনা এমন কিছু পরিবার থাকে তা মানুষের চোখে পড়েও পড়েনি। পড়লেও তাদের ঘরের খবর কে জানত...? এমনই একটি পরিবারের কথা তুলে এনেছেন তিনি আমাদের সামনে। যা আমাদের একটা সময়ের কথা বলে। কিছু মানুষের কথা বলে। আর তাদের বেঁচে থাকার সংগ্রামের কথা বলে।


Tags : bangla tutorial,bangla current affairs,rgj bangla,how to convert word to pdf bangla,pdf,word to pdf,bangla book pdf,hs bangla mcq pdf,hs bangla saq pdf,bangla word to pdf,ms word to pdf bangla,bangla question pdf,bangla pdf book download,quran shikkha bangla pdf,bangla movie,crate pdf file in bangla,bangla cartoon,how to make pdf file bangla,pdf convert bangla tutorial,bangla book pdf free download,bangla,bangla word file to pdf converter, bangla pdf book download,bangla book pdf free download,pdf,bangla book pdf,bangla,bangla tutorial,bangla current affairs,hs bengali question paper 2022 pdf download,class 11 bengali question 2022 pdf download,how to download bangla book pdf free,r s agarwal gs bangla pdf download exam guruji,r s agarwal general science bangla pdf download,how to convert word to pdf bangla,free download,how to download free pdf bangla and english book,download bangla board boi

Next Post Previous Post