দক্ষিণ আফ্রিকার উপন্যাস এবং জে এম কুদজিয়া - সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

দক্ষিণ আফ্রিকার উপন্যাস এবং জে এম কুদজিয়া 

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

দক্ষিণ আফ্রিকা সম্বন্ধে যারা ওয়াকিবহাল তারা জানেন ওই দেশের 'সামাজিক অবস্থা কতটা বিভীষিকাময়, জাতিগত বৈষম্য কতটা প্রকট। সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গরা শুধু বাহুবলে এবং সাম্রাজ্যবাদী দোসরদের সক্রিয় সহযােগিতায় সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর যে নির্যাতন চালাচ্ছে, তার তুলনা ইতিহাসে প্রকৃতই বিরল। দেশটি প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ, এর অর্থনীতি উন্নত, এর ভৌগােলিক অবস্থানও গুরুতুপূর্ণ - সাদারা শিল্প বাণিজ্য, প্রশাসন, শিক্ষাসহ যাবতীয় ক্ষেত্রে মার্তণ্ড প্রতাপে আধিপত্য বজায় রেখে যাচ্ছে। কৃষ্ণাঙ্গ ছাড়াও ভারতীয় বংশােদ্ভুত ও মিশ্র বর্ণের জনগােষ্ঠী এবং ক্ষুদ্রজাতির লােকজন রয়েছে ওই দেশে, যাদের অবস্থা একই রকম শােচনীয়। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে এই অস্বাভাবিক বর্ণবৈষম্যবাদ, যার একটি চটকদার নামও আছে ~~~ apartheid --- আফ্রিকানার ভাষা থেকে উদ্ভূত, যা মাঝে মাঝে জাতিসংঘে, বিভিন্ন দেশের জাতীয় সংসদে, সংবাদপত্রে, এমনকি বাংলাদেশের মফস্বলের শহরগুলিতেও নানা সভা-সমিতিতে ঘৃণাভরে উচ্চারিত হয়। তবে, প্রেসিডেন্ট বােথা ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের খুঁটির জোর এমনি যে এতে তাদের অবস্থার উনিশ-বিশ খুব একটা হয়নি। রােনাল্ড রিগান এবং শ্রীমতী থ্যাচার তাদের দুই পরাক্রমশালী মিত্র, এঁদের ঠেকানাে সহজ কথা নয়। কয়েক মাস আগে আমেরিকার সিবিএস টেলিভিশনে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। এটি উপস্থাপনা করেছিলেন আমেরিকার সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় টেলিভিশন-সংবাদ ব্যক্তিত্ব, ওয়াল্টার ক্রনকাইট, যার সম্বন্ধে বলা হয়ে থাকে যে তিনি আমেরিকার সবচেয়ে সৎ চেহারার অধিকারী। একবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হওয়ারও আমন্ত্রণ জানানাে হয়েছিল তাকে, যা তিনি বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে ক্রনকাইট দক্ষিণ আফ্রিকার অনেক প্রতিবাদী তরুণ এবং বালকের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। এর মধ্যে একটি স্কুলের ছাত্রও ছিল, যাকে একাধিকবার গ্রেপ্তার করে নির্যাতন করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকার পুলিশ। ওই ছেলেটি অবলীলায় তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিল, তার কণ্ঠস্বরে ছিল আশ্চর্য বলিষ্ঠতা এবং দেশপ্রেম । আমি অবাক বিস্ময়ে ওই ছেলেটির ভাঙা ইংরেজিতে দেওয়া সাক্ষাৎকারটি শুনছিলাম এবং নিজের দেশের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে দেখতে অপার গ্রানিবােধে আক্রান্ত হচ্ছিলাম। প্রবীণ এবং তুখােড় সাংবাদিক ক্রনকাইট নিজেও অভিভূত হয়েছিলেন, বােঝা যাচ্ছিল, কিন্তু বালকটি যখন তার সমূহ বিপদের কথা বলছিল, তখনাে একটু বিচলিত দেখাচ্ছিল না তাকে, না তার বন্ধুদের, যারা সায় দিচ্ছিল তার প্রত্যেক বক্তব্যের সঙ্গে। ওই ছেলেটির আশঙ্কা ছিল তাকে হত্যা করা হবে, কারণ টেলিভিশনের সৌজন্যে তার মুখটি প্রচুর গােয়েন্দার কাছে চেনা হয়ে যাবে। এবং আমেরিকার সবচেয়ে সৎ মানুষটিকে স্তম্ভিত করে, মাস দুয়েকের মধ্যে বালকটির মৃত্যুসংবাদ সিবিএসের সান্ধ্যকালীন খবরে প্রচারিত হলাে। কোথাও কোনাে উচ্চবাচ্য হয়নি, সংবাদপাঠক ড্যান রাদারের কণ্ঠস্বর একটু করুণ শুনিয়েছিল - ওই পর্যন্তই। আর কেউ না হলেও দক্ষিণ আফ্রিকার শাসকবৃন্দের শক্তির বড় নির্মম পরিচয়টি ওইদিন ক্রনকাইট জানতে পেরেছিলেন। 

দক্ষিণ আফ্রিকার এইসব প্রতিবাদী বিপ্লবী তরুণ একেবারে এই প্রজন্মের এবং সংখ্যায় তারা বৃদ্ধি পাচ্ছে - তাদের বঞ্চনা, নিপীড়ন ও দারিদ্র্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। এরা নেলসন ম্যান্ডেলার ভাবশিষ্য, বা বেঞ্জামিন মলয়সের সহােদর। এঁদের আত্মবিশ্বাস ইতিহাসকে একদিন নিয়ন্ত্রণ করবে, এর নানা উপসর্গ এখনই দেখা দিতে শুরু করেছে। কিন্তু এই দলে, দুঃখের বিষয়, একটিও শ্বেতাঙ্গকে দেখা যায় না সাদা-কালাের যে চূড়ান্ত বিভাজন সময়ের অদৃশ্য হাতে রচিত হয়েছে ওই অন্ধকার দেশে, তার রূপটি নিতান্তই স্বয়ংসম্পূর্ণ, অপরিবর্তনশীল। ক্রনকাইট আরাে সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন বােথা ও ম্যান্ডেলার কন্যাদের। বােথার কন্যা বােথারই মতাে, নির্মম, বীভৎস এবং রুচিহীন; ম্যান্ডেলার মেয়ে বাবার মতাে দীপ্ত, বিদ্রোহী এবং স্পষ্টবাদী। তাদের চরিত্রগত ব্যবধান তাদের অবস্থানগত ব্যবধানের মতােই দুই মেরুবাসী। 

যে শ্বেতাঙ্গরা দক্ষিণ আফ্রিকার সামরিক, বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত এবং যারা রাজনীতি ও শিল্প-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত, তাদের চরিত্র কী হবে, তা আন্দাজ করা যায়। এরা সবাই এক গােয়ালের গরু, যে গােয়ালে বােথা হচ্ছেন প্রধান ঋষভ। কিন্তু যারা পেশাজীবী, অধ্যাপক, আইনজ্ঞ, শিল্পী-সাহিত্যিক তাদের অবস্থান কী, বর্ণবৈষম্য প্রশ্নে, এই কথাটি জানতে বহুদিন থেকে আগ্রহী ছিলাম। দক্ষিণ আফ্রিকার একটি প্রতিবাদী শ্বেতাঙ্গ দম্পতির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম বছর দশেক আগে, তাদের প্রতিবাদ যদিও এতটা জলাে এবং প্রাণহীন, যে আমাদের সরকার-বিরােধী আন্দোলনে মুসলিম লীগের একজন পাণ্ডাকেও তাদের সামনে আকর্ষণীয় মনে হবে। তবে তারা ন্যাডিন গর্ডিমারের কাজের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, যা ছিল আমার এক বড় লাভ। ক্রনকাইট তার অনুষ্ঠানে কোনাে সাহিত্যিককে নিয়ে আসেননি, কোনাে শিল্পীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেননি। তবে ওই সময় ক্রাই ফ্রিডম নামে একটি চলচ্চিত্র আমেরিকায় ঝড় তুলছিল। শহীদ স্টিভেন বিকোর সঙ্গে একজন শ্বেতাঙ্গ সাংবাদিকের বন্ধুত্ব এবং পুলিশের নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য ওই সাংবাদিকের পালিয়ে আসার ঘটনা নিয়ে ওই চলচ্চিত্র। যেহেতু গর্ডিমারের দুটি উপন্যাস আমার পড়া। হয়ে গিয়েছিল, ওই চলচ্চিত্রের আবেদনটি আমার কাছে ছিল ভিন্ন মাত্রার - বলা যায় দক্ষিণ আফ্রিকার ঘটনাপ্রবাহ এবং শিল্পী-সাহিত্যিকদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার একটি রূপ আমি গর্ডিমারের লেখা থেকে হেঁকে আনতে পেরেছিলাম। শ্বেতাঙ্গ কোনাে লেখক শিল্পী যে মনেপ্রাণে কৃষ্ণ বিপ্লবীদের সমর্থন দিতে অপারগ, যেহেতু তাদের নিজস্ব অস্তিত্ব তাতে বিলীন হয়ে যায় এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বেগ পেতে হয়নি । এবং সাম্প্রতিককালে পড়া (যদিও প্রকাশকাল কয়েক বছর আগে) অন্য এক দক্ষিণ আফ্রিকান ঔপন্যাসিক, জে এম কুদজিয়ার দুটি উপন্যাস আমার সিদ্ধান্তকে অপরিবর্তিত রাখতে সাহায্য করেছে। 

ওই দেশের শ্বেতাঙ্গ বুদ্ধিজীবী ও শিল্পী-সাহিত্যিকরা বিবেকের দংশন অনুভব করছেন না এ কথা বললে সত্যের অপলাপ হবে। তারা অনেকেই apartheid-কে মনেপ্রাণে ঘৃণা করেন, অসাম্যমূলক সমাজ ও প্রশাসন ব্যবস্থার তাঁরা অবসান চান, তাঁদের অনেকেই পুলিশি জুলুম ও জেলশাস্তিও ভােগ করেছেন। কিন্তু শেষ বিচারে তাঁদের প্রতিবাদ কিন্তু কালাে মানুষের প্রতিবাদ নয়, তাতে ঘৃণা থাকলেও আগুন নেই। তা প্রচলিত ব্যবস্থাকে পােড়াতে পারে না, নিজের ভেতরে তাতে গােপনে রক্তক্ষরণ হয়। গর্ডিমারের প্রতিবাদ স্পষ্ট, তিনি সরাসরি অভিযুক্ত করেন রাজনীতি ব্যবসায়ীদের, প্রশাসকদের। মুক্তিকামী মানুষের রাজনীতির প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রশ্নাতীত, কিন্তু গর্ডিমারের উপন্যাসের পৃথিবীতে এই আনুগত্য কোনাে আনন্দের জন্ম দেয় না, শ্বেতাঙ্গ হিসেবে এর ফলাফল তার জন্য নিরানন্দময়। এজন্য তাঁর উপন্যাসের জগৎ তমসাচ্ছন্ন - তার আফ্রিকানার শ্বেতাঙ্গ জনগােষ্ঠী এক নিয়তিতাড়িত অন্ধকার জনগােষ্ঠী । সে তুলনায় ভারতীয়রা, মিশ্রবণীয়রা অনেক বেশি প্রাণােচ্ছল, যেহেতু ভবিষ্যৎ তাদের, বর্তমান দুঃসহ হলেও। দি লেট বুর্জোয়া ওয়ার্ল্ড উপন্যাসে রাজনীতির সঙ্গে ঘটনার যােগ প্রবল না হলেও এই নিয়তিনির্দিষ্ট মানুষজনকে শেষ পর্যন্ত রাজনীতির দায়দায়িত্ব গ্রহণ করা ছাড়া উপায় থাকে না। কিন্তু সেই গ্রহণে সােৎসাহ commitment থাকে অনুপস্থিত। 

কুদজিয়ার সেরা উপন্যাসগুলির দুটি ওয়েটিং ফর দি বারবারিয়ানস ও দি লাইফ অ্যান্ড টাইমস অফ মাইকেল কে এক বছরের ব্যবধানে রচিত। শেষােক্ত গ্রন্থের জন্য ১৯৮৩ সালে তিনি বুকার পুরস্কারে সম্মানিত হন। এই দুটি গ্রন্থেই তিনি বেড়ে উঠেছেন, তার চিন্তা সংহত হয়েছে, প্রকাশ হয়েছে বিচিত্র অথচ নিয়ন্ত্রিত এবং তার বিষয়বস্তুতেও চমৎকারভাবে প্রতিফলিত হয়েছে সমাজ, মানুষ ও ইতিহাস নিয়ে তার নানা চিন্তা । ওয়েটিং ফর দি বারবারিয়ানস-এ বর্ণিত হয়েছে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের জবানিতে, যার অভিজ্ঞতার পৃথিবীটি ক্রমশ নিষ্ঠুর থেকে নিষ্ঠুরতর হয়ে ওঠে। গােয়েন্দা পুলিশি নির্যাতন, জেলজুলুম এই উপন্যাসের বিস্তৃত পটভূমি, কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট ভদ্রলােক এই নির্যাতনের মধ্যে তার নিজের সভ্যতার বিকৃত সত্তাটিকে আবিষ্কার করে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন; তার কাজকর্ম হয়ে ওঠে রাষ্ট্রবিরােধী। এই বিরােধিতার পাশাপাশি চলে তার আত্মসমালােচনা এবং আত্ম-উন্মোচন । গ্রন্থের শেষে নির্যাতনকারীদের সঙ্গে নিজেকে একই আসনে দেখেন এই ম্যাজিস্ট্রেট এবং তার নিজস্ব সভ্যতার একজন ধারক হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করেন। নিজের বিরুদ্ধে তার অপার ঘৃণা, কিন্তু সভ্যতার প্রতিটি বীভৎস মূখােশকে তিনি নির্মমভাবে উন্মােচনেও নিবেদিত । উপন্যাসের একটি দৃশ্য গৃঢ়ভাবে প্রতীকী । একটি বালককে নির্যাতন করে পুলিশ ফেলে রেখেছে, ম্যাজিস্ট্রেট তাকে দেখতে গিয়েছে - মুমূর্ষ বালককে সে বলছে, এখন থেকে তােমার দুঃস্বপ্নের শেষ’ । নিতান্ত ফাঁকা বুলি হয়ে দাঁড়ায় এই আশ্বাসবাণী এবং প্রতীকীও - সমগ্র দেশটির হঠকারিতা, দুঃস্বপ্ন এবং আসন্ন। অপমৃত্যুকে চিহ্নিত করে এই অসার অভয়বাণী।

দি লাইফ অ্যান্ড টাইমস অফ মাইকেল কে-র প্রধান চরিত্র, বারবারিয়ানস উপন্যাসের ম্যাজিস্ট্রেটের মতােই ইতিহাস বিচ্ছিন্ন হয়ে বেঁচে থাকতে চায়, তবে তার আন্তরিকতাকে প্রশ্ন করা যায় না । ম্যাজিস্ট্রেটের চিন্তায় মাঝে মাঝে চালাকি থাকে, প্রতারণা থাকে, কিন্তু কে’র চিন্তাভাবনা অপেক্ষাকৃত সরলরৈখিক। কে’র মৃদু শারীরিক প্রতিবন্ধী অবস্থা (তার বুদ্ধি কম, কথাবার্তায় সে ধীরগতি) এই আন্তরিকতার জন্য কতখানি দায়ী, বলা সম্ভব না হলেও বােঝা যায়, সাধারণ একজন মানুষ থেকে তাকে আলাদা করে দেখানাের মধ্যে কুদজিয়ার একটি প্রতীকী অভিসন্ধি ছিল। 

সাধারণ বুদ্ধিতে যা যুক্তিযুক্ত শ্বেতাঙ্গদের কাছে, তা অসার প্রমাণিত করতে হলে ওই তথাকথিত সাধারণ বুদ্ধি বা কাণ্ডজ্ঞানকে বিসর্জন দিতে হবে। কে’র অবস্থানটি নিতান্তই দুর্ভাগ্যজনক। কেপ টাউনের কঠোর বর্ণবাদে বড় হওয়া তার পৃথিবী চারদিক থেকে আক্রান্ত গেরিলারা গ্রামাঞ্চলে যুদ্ধরত, উত্তরে সীমান্ত যুদ্ধ, দেশটি সামরিক শাসনের জাঁতাকলে, শহরে দুর্ভিক্ষাবস্থা। সময়টি অদূর ভবিষ্যৎ। এই নিদারুণ সময়ে কে একটি ব্যক্তিগত কাজে নিজেকে ব্যাপৃত করে। সে শহরের বিভিন্ন ক্যাম্পের মাঝখানে খালি জায়গায় বাগান করে। কাজটিও লক্ষণীয়। কে’র কার্যক্রমে আভাস পাওয়া যায় যে সে সচেতনভাবে তার সময়কে, ইতিহাসকে, তার দেশের যাবতীয় প্রতিষ্ঠানকে নাকচ করেছে, তার বাগান রচনা প্রতীকী অর্থে এক শৈল্পিক নির্মাণ। কুদজিয়া এই নির্মাণের মধ্যে কিন্তু সমষ্টির মুক্তি খোঁজেন না। ব্যক্তি তার নিজস্ব নির্বাণের পথ করে তার একান্ত কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। এই উপন্যাসের দ্বিতীয়াংশে একটি পুনর্বাসন কেন্দ্রের ডাক্তারি বিভাগের পিয়ন কে’র সাহায্য প্রার্থনা করে, কল্পনায় কে’কে তাড়িয়ে নিয়ে যায় কেপ অঞ্চলের বিস্তৃত সমভূমি দিয়ে। তার সমাজ ব্যবস্থায় পাকাপােক্তভাবে যে অশুভ আসন পেতে নিয়েছে, তার নিষ্ঠুরতায় পিয়নটি, কে’র মতােই, দুঃস্বপ্ন তাড়িত। কুদজিয়ার দুটি উপন্যাসেই তমসাগ্রস্ত মানুষজন কোনাে আলাে দেখতে পায় না, শুধু নিজের ভেতর ইতিহাসের অনিশ্চিত পদধ্বনি শুনে, একটু ধূসর হয় ওই অন্ধকার এবং এক অজানা গ্লানিবােধ তাদের নিজেদের মুখােমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। 

কুদজিয়া সচেতনভাবে অনুকরণ করেছেন কাফকা, বেকেট, নবােকভকে -- কাফকার দুঃস্বপ্নের পৃথিবী জেগে থাকে তাঁর উপন্যাসে। ভয়ভীতি এবং নিষ্ঠুরতা সেখানে প্রবল পক্ষ। সমালােচকরা কুদজিয়ার । তিনটি বিশেষত্বকে আলাদা করেছেন, যা তুলনামূলক বিচারে কাফকা-বেকেট-নবােকভ থেকে আহরিত, যদিও কুদজিয়ার নিজস্ব নির্মাণে এই বিশেষত্বসমূহ একান্তই একটি নিজস্ব আকৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তাঁর গদ্যভাষা; নিষ্ঠুরতা, ভয়-ভীতি, দুঃখ-যন্ত্রণা, এবং মানুষের নির্মিত প্রতিষ্ঠানসমূহের বীভৎসতার প্রতি তাঁর দীর্ঘস্থায়ী আকর্ষণ; এবং বর্তমান সময় ও ইতিহাসের ক্রীড়নক মানুষের অসহায় অবস্থা। কুদজিয়ার উপন্যাসে দক্ষিণ আফ্রিকার গদ্য সাহিত্যের একটি প্রধান পরিচয় পাওয়া যায়, লার্স এঙ্গল যাকে complicity plot বলেছেন। 

অর্থাৎ সজ্ঞানে-অজ্ঞানে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গরা তাদের অসম সমাজব্যবস্থার সঙ্গে একটি বন্ধনে জড়িয়ে পড়ে। তারা জানে ওই সমাজব্যবস্থা অশুভ এবং তাদের রক্ষা করার জন্যই এর উদ্ভব, কিন্তু এর মূলােৎপাটন তাদের সম্ভব হয় না। তারা শক্তিহীনতায় ভােগে, প্রবল দ্বন্দ্বে নিপতিত হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত, একান্ত জীবনে, অনিষ্টের নাগালের বাইরে একধরনের নির্বাসনে তারা দেশান্তরী হয়। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে আসা কবি ও ঔপন্যাসিক ক্রিস্টোফার হােপ তার হােয়াইট বয় রানিং (১৯৮৮) বইতে এদের সম্বন্ধে বলেছেন ‘ঘর ছাড়ার অনেক আগেই তারা দেশান্তরী হয়ে গেছে। এই অর্থে দেশ ও সময়কে তারা ভুলে যেতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয় না । 

অনিশ্চয়তা, নিষ্ঠুরতা, শঙ্কা তাদের জীবনের নিত্যসঙ্গী থেকে যায় । কুদজিয়ার দুটি উপন্যাসে সমকালীন দক্ষিণ আফ্রিকার সমাজের প্রত্যক্ষ চিত্রায়ণ নেই, উভয় ক্ষেত্রেই সমাজের সঙ্গে প্রধান চরিত্রের সম্পর্ক তিক, কৌণিক। নিজভূমে পরবাসী এইসব মানুষজন নিজেদের জীবনে বিভ্রান্তিতে ভােগে, স্ববিরােধিতার শিকার হয়, ইতিহাস অথবা প্রকৃতির অভ্যন্তরে আশ্রয় খােজে কিন্তু তাদের অস্তিত্ব এইসব টানাপােড়েনে করুণ থেকে করুণতর হয়। একসময় পাঠকের সহানুভূতি জাগে তাদের জন্য। আধুনিক উপন্যাসের victim hero-র মতাে, সল বেলাে এবং নবােকভের অনেক কুশীলবের মতাে, তারা এক আশ্চর্য নিয়তিবােধে আক্রান্ত হয়। 

 কুদজিয়ার ভাষাটি অভূতপূর্ব। তার বর্ণনায় ছলচাতুরী নেই, তিনি অত্যন্ত নৈর্ব্যক্তিকভাবে সবচেয়ে জটিল মনস্তাত্ত্বিক উন্মোচনগুলিকেও বাঙময় করে তােলেন; তার চরিত্ররাও এই শৈলীগত বিশিষ্টতায় চিহ্নিত হয়ে যায় । চরিত্রকে শৈলীর বিষয়ে পরিণত করার এই শক্তিটি কুদজিয়াকে বিশিষ্টতা দিয়েছে নিঃসন্দেহে। 

তবে দক্ষিণ আফ্রিকায় এখনাে একজন ফ্রানৎস ফ্যাননের কণ্ঠ শুনতে গেলে নিরাশ হতে হবে। সে সম্ভাবনা আপাতত সুদূরপরাহত। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ সাহিত্যিকের এই স্বাভাবিক সীমাবদ্ধতার জন্যই বােধ হয় শৈলীগত উৎকর্ষ অনেক ইংরেজি বা আমেরিকান উপন্যাসকে ছাড়িয়ে যায়। কুদজিয়া এমন একটি উদাহরণ। 

জুলাই, ১৯৮৮ 



Tags : bangla tutorial,bangla current affairs,rgj bangla,how to convert word to pdf bangla,pdf,word to pdf,bangla book pdf,hs bangla mcq pdf,hs bangla saq pdf,bangla word to pdf,ms word to pdf bangla,bangla question pdf,bangla pdf book download,quran shikkha bangla pdf,bangla movie,crate pdf file in bangla,bangla cartoon,how to make pdf file bangla,pdf convert bangla tutorial,bangla book pdf free download,bangla,bangla word file to pdf converter, bangla pdf book download,bangla book pdf free download,pdf,bangla book pdf,bangla,bangla tutorial,bangla current affairs,hs bengali question paper 2022 pdf download,class 11 bengali question 2022 pdf download,how to download bangla book pdf free,r s agarwal gs bangla pdf download exam guruji,r s agarwal general science bangla pdf download,how to convert word to pdf bangla,free download,how to download free pdf bangla and english book,download bangla board boi

Next Post Previous Post