বইটির মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে রেলের ইতিহাস এবং বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে রেলের প্রভাব, সুদীর্ঘ রেল ইতিহাসের প্রতিটি রেল সেকশন নির্মাণ এবং ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ, সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে গল্পের ছলে ইতিহাস উপস্থাপন। রেল সম্পর্কিত সামগ্রিক বিষয়াবলি একত্রিত করে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যেন বইটি চলমান তথ্যের ভাণ্ডার।
রেলওয়ে আবিষ্কার এবং ভারতবর্ষে রেলওয়ে
ধরুন, আপনি দূরে কোথাও ভ্রমণে যাবেন। এই দীর্ঘভ্রমণের বিরক্তিকর সময়গুলোকে উপভোগ্য করার জন্য সঙ্গে করে কিছু বই নিলেন বাসের মধ্যে বসে পড়বেন বলে। কিন্তু যাত্রাপথে ইট-পাথুরে সড়কের ধুলাবালি, চিৎকার-চেঁচামেচি, গাড়ির হাইড্রোলিক হর্নের তীব্র শব্দ আর দূষিত কালো ধোঁয়া আপনার সব পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিল। বই পড়া তো দূরে থাক, একটু পরপর গাড়ির শক্ত ব্রেকের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতেই বেগ পেতে হচ্ছে। বিরক্তিকর সময়গুলোকে আর উপভোগ করতে পারলেন না। সঙ্গে করে যে পড়ার জন্য বই নিয়ে এসেছিলেন এই ক্লান্তিকর জার্নিতে সেটাও ভুলে গেলেন।
অথচ রেলের কথা ভাবুন, দিগন্তবিস্তৃত সবুজ মাঠের মাঝখান দিয়ে ঝকঝক রব তুলে ছুটে চলেছে ট্রেন। ট্রেনের জানালা খুলে দিতেই প্রকৃতির স্নিগ্ধ শীতল হাওয়া আপনার হৃদয়ে পরশ বুলিয়ে দিল, হাতে একখানা শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের বই আর এক হাতে চায়ের কাপ, যাত্রাপথে এর চেয়ে উপভোগ্য সময় আর হতে পারে না। বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে জানালা দিয়ে চোখ বুলালেই সবুজের ওপারে আবছা গ্রামগুলো দেখা যায়। কখনো সবুজ ধানের মাঠ, কখনো সারি সারি খেজুরগাছ, কখনো আঁকাবাঁকা গ্রামীণ মেঠোপথ, কখনো সর্পিলাকার নদী, কখনো আবার হাওর-বাঁওড় ও বিলের বিস্তৃত জলরাশি সবকিছুই উপভোগ করা যায় ট্রেনে চড়ে।
যাত্রীবান্ধব বাহন হিসেবে রেলের সুনাম সেদিন থেকেই, যেদিন থেকে পৃথিবীর বুকে রেলগাড়ি চলতে শুরু করেছে। একটি সিঙ্গেল লাইন হয়। এ ছাড়া রেলের পরিবহনব্যয় সড়কপথের তুলনায় ৭০% কম। রেলপথ নির্মাণ ও আনুষ্ঠানিক প্রাথমিক খরচও সড়কপথের তুলনায় প্রায় ৬৫-৭৫ শতাংশের কম। অথচ রেল এত কম খরচেই কোনো প্রকার যানজট ছাড়া নির্বিঘ্নে এক বিশাল পরিমাণ যাত্রী ও মালামাল পরিবহন করে থাকে।
সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে বিশ্বব্যাপী পরিবহনজনিত কারণে যে পরিবেশদূষণ হচ্ছে, এর জন্য রেল মাত্র ৪ শতাংশ দায়ী। যেখানে সড়ক পরিবহন ৭৪ শতাংশ, আকাশ পরিবহন ১১ শতাংশ এবং নৌপরিবহন ১১ শতাংশ দায়ী। একইভাবে বিশ্বব্যাপী পরিবহন খাতে যে পরিমাণ জ্বালানি খরচ হচ্ছে তার মাত্র ১.৬ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে রেলওয়ে খাতে। যেখানে সড়ক পরিবহনের ক্ষেত্রে ৭৬.৫ শতাংশ, আকাশ পরিবহনের ক্ষেত্রে ১১.২ শতাংশ এবং নৌপরিবহনের ক্ষেত্রে ১০.৭ শতাংশ জ্বালানি খরচ হচ্ছে। তাই রেলের চেয়ে পরিবেশ ও প্রকৃতিবান্ধব যোগাযোগব্যবস্থা যে আর নেই, এ কথা নিশ্চিন্তে বলে দেওয়া যায়।
এ ছাড়া নিরবচ্ছিন্ন যাত্রা, আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা, প্রকৃতির হাতছানি, ক্লান্তিহীন দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া, বিলাসী ভ্রমণ, কিংবা নিরাপদ যাত্রা- সবখানেই রেলের কর্তৃত্বটাই সব থেকে বেশি। রেল হচ্ছে স্থলপথের সবচেয়ে নিরাপদ বাহন। স্থলপথে যোগাযোগের জন্য কিংবা ভ্রমণের জন্য রেলের চেয়ে পরিবেশবান্ধব এবং নিরাপদ বাহন আর দ্বিতীয়টি নেই। একটা সমীক্ষা থেকে রেলের নিরাপত্তার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিশ্বব্যাপী মোট পরিবহন দুর্ঘটনার জন্য ৯৬ শতাংশ সড়ক পরিবহন দায়ী, সেখানে রেলের দায় মাত্র ৩.৮৪ শতাংশ।
তা ছাড়া রেল স্থলপথের অন্যান্য বাহনের চেয়ে তুলনামূলক গতিশীল হয়ে থাকে। খুব কম সময়ের মধ্যেই পৌঁছানো যায় দূর-গন্তব্যে। তাই যুগ যুগ ধরে রেলভ্রমণের আনন্দ এবং রেলের সুবিধা বিবেচনায় স্থলপথের বাহন হিসেবে রেলের গুরুত্ব ছিল সব থেকে বেশি। নিত্যনতুন আধুনিক সব সড়ক পরিবহন সার্ভিস কিংবা বিলাসবহুল সড়ক যান এলেও রেলের গুরুত্ব কমেনি এতটুকুও। বরং দিন দিন বিশ্বব্যাপী রেলব্যবস্থার বিপ্লব ঘটে চলেছে। উন্নত বিশ্বের সড়ক পরিবহনের তুলনায় রেলকে সব সময় বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তৈরি হয়েছে অত্যাধুনিক সব ট্রেন। উন্নত বিশ্বে এমন ট্রেনও আছে, যেগুলো বিমানের গতিতে কিংবা তার চেয়ে বেশি গতিতেও চলতে পারে। আর এসব ট্রেনের বিলাসিতার কথা শুনলে তো আপনার চক্ষু চড়ক গাছে উঠবে নিশ্চিত।
রেল যখন আবিষ্কৃত হয়েছে যখন স্থলপথের বাহন হিসেবে অটোমোবাইল ইঞ্জিন আবিষ্কার হয়নি। তাই এ সময় স্থলপথে যাতায়াতের একমাত্র বাহন ছিল ঘোড়ার গাড়ি কিংবা ভারতীয় উপমহাদেশে গরুর গাড়ি। তা ছাড়া পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে এবং মালামাল স্থানান্তরের ক্ষেত্রে হাতি ছিল উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান বাহন। ক্লান্তিকর এবং যন্ত্রণাদায়ক এই যাত্রাপথকে নির্বিঘ্ন করেছে রেলওয়ের আবিষ্কার। রেল চলার পথকে করেছে সহজ এবং আনন্দদায়ক। ট্রেনে চেপে বসে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই দূরতম গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া যায়। এমনকি ট্রেনের মধ্যে বসে গেম খেলা, লেখালেখি, বই পড়া, চায়ের কাপে চুমুক কিংবা রহস্য নিয়ে গবেষণা- সবকিছুই করা সম্ভব।
বাংলাদেশের রেলের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমেই আমাদের রেল আবিষ্কারের ইতিহাস সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা নেওয়া প্রয়োজন।
রেলগাড়ি সাধারণত সড়কপথের অন্যান্য যানবাহনের তুলনায় কম ঘর্ষণজনিত বাধার সম্মুখীন হয়। যার কারণে রেলপথের যাত্রা হয় সড়কপথের তুলনায় মসৃণ। ঘর্ষণজনিত বাধা কম থাকার কারণে একাধিক বগি সংযুক্ত করার পরও একটি ট্রেন তার স্বাভাবিক গতি বজায় রাখতে পারে। মজার ব্যাপার হলো, আমরা প্রায়ই একটা জিনিস ভুল করে থাকি। আর তা হলো, আমরা যেটাকে রেলগাড়ি বলে থাকি, সেটা মূলত রেলগাড়ি নয়, সেটা হল ট্রেন। অর্থাৎ, যখন একাধিক রেলগাড়ি একটার সঙ্গে অন্যটা জুড়ে দেওয়া হয় তখন সেটাকে বলে ট্রেন। আর ট্রেনের প্রতিটি কোচ এবং বগির সমন্বিত অংশকে বলে রেলগাড়ি।
আবার সচরাচর আমরা যেটাকে বগি বলে থাকি, সেটা মূলত রেলওয়ে কোচ। বগি হলো একটা রেলগাড়ির নিম্নাংশের মূল কাঠামো। আর কাঠামোর ওপরের যে খোলসে বসে আমরা ভ্রমণ করি, সেটা হলো কোচ।
রেলগাড়ি আবিষ্কার
অষ্টাদশ শতকের শেষাংশের কথা। প্রতিদিনের মতোই চা তৈরির জন্য কেটলিতে পানি গরম করছিলেন জেমস ওয়াট নামে এক ইংরেজ ভদ্রলোক। কিন্তু সেদিন তিনি খেয়াল করে দেখলেন, চায়ের কেটলির ফুটন্ত পানির বাষ্প বারবার ঢাকনাকে ওপরের দিকে ঠেলে তুলছে। তখনই তাঁর মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল, কেটলির পানি গরম করার ফলে গরম পানির বাষ্প নিশ্চয়ই শক্তি উৎপাদন করছে। আর এই শক্তিকে যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, তাহলে মানবকল্যাণে এটি বিরাট ভুমিকা রাখবে। এই চিন্তা মাথায় আসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি একটুও বসে থাকলেন না। বাষ্পশক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য পুরোদমে কাজে নেমে পড়লেন। অনেক সাধনা ও গবেষণার পর ১৭৬৩ সালে তিনি একটি সম্পূর্ণ বাষ্পীয় ইঞ্জিন তৈরি করে ফেললেন। তবে এটা রেল ইঞ্জিন ছিল না।
চিত্র ১: ১৭৬৩ সালে জেমস ওয়াট কর্তৃক আবিষ্কৃত প্রথম বাষ্প ইঞ্জিন
এর কয়েক দশক পরে ১৮০৪ সালে ইংল্যান্ডের রিচার্ড ট্রেভিথিক রেলের জন্য একটি বাষ্পীয় ইঞ্জিন তৈরি করতে সক্ষম হন। তারপর ১৮১২ সালে ইংল্যান্ডের ম্যাথিউ মারে দাঁতওয়ালা রেললাইনের ওপর খাঁজকাটা চাকার স্টিম ইঞ্জিন চালিয়ে দিলেন। কিন্তু এসব ইঞ্জিন পূর্ণাঙ্গ ছিল না। আর নির্মাণের পর নানাবিধ সমস্যার কারণে বেশি দিন চালানোও যায়নি।
ইংল্যান্ডের নিউ ক্যাসেল কয়লা খনির এক শ্রমিক ভাবছিলেন, রেললাইনের ওপর দিয়ে যে ট্রলিগুলোকে ঠেলে নিয়ে যেতে হয়, তা যদি যন্ত্রশক্তি দিয়ে করা যেত! তাহলে মানুষ ও ঘোড়ার কষ্ট অনেকটা লাঘব হতো। পরে সেই শ্রমিক খনির লিফটে কাজ করার সুযোগ পেলেন। ফলে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ খুলে যায়। তখন থেকে তিনি উঠে পড়ে লেগে গেলেন এমন একটা যন্ত্র বানানোর কাজে। ১৮১৪ সালে আসে সাফল্য। কয়লার ট্রলিগুলোর মাথায় বাষ্প ইঞ্জিন লাগিয়ে দিব্যি একটা ট্রেন বানিয়ে ফেললেন তিনি। এই বাষ্প ইঞ্জিনটির নাম ছিল 'রুচার'। রুচারের ওজন ছিল প্রায় ৩০ টন।
কিন্তু কয়লা খনিতে চালিত সেই যান বাস্তবিক অর্থে ট্রেন ছিল না। সেই শ্রমিকের নাম জর্জ স্টিফেনসন। ১৮১৯ সালে নিজ উদ্যোগে সান্ডারল্যান্ডে ৮ মাইল দীর্ঘ রেললাইন বসান তিনি। সে বছরই প্রথম মেশিন-নির্ভর রেলওয়ে যাত্রা শুরু হয়। এটা মোটামুটি সাড়া ফেলে দেয় পুরো ইংল্যান্ডে। শিল্প-উদ্যোক্তারা স্টিফেনসনের পেছনে টাকা ঢালতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। সেই অর্থ এবং লোকবল নিয়েই নেমে পড়েন আধুনিক ইঞ্জিন নির্মাণের কাজে। তারপর শুরু হয় রেলওয়ের যুগ। তিনি তাঁর কোম্পানির নাম দেন 'রবার্ট স্টিফেনসন অ্যান্ড কোম্পানি'।
বিশ্বের সর্বপ্রথম স্টিম রেল ইঞ্জিনটি তৈরি হয় ইংল্যান্ডে। জর্জ স্টিফেনসন এবং তাঁর ছেলে রবার্ট স্টিফেনসনের এক যুগান্তকারী প্রচেষ্টায় ১৮২৫ সালে আবিষ্কৃত হয় বিশ্বের প্রথম ট্রেন। সে বছরই ইংল্যান্ডের স্টকটন থেকে ডার্লিংটন পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার রেলপথ নির্মিত হয় এবং ট্রেন চলতে শুরু করে। ২৭ সেপ্টেম্বর জনসাধারণের জন্য রেলপথটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। চলতে শুরু করে বিশ্বের প্রথম আবিষ্কৃত বাষ্পচালিত ট্রেনটি। স্টিফেনসন নিজেই সেদিন স্টকটন থেকে ডার্লিংটন পর্যন্ত ভ্রমণ করেন।