আঁচড় - সাবের চৌধুরী
আঁচড়!
শিশুদের বিশেষ একটি দিক নিয়ে লিখব বলে শিরোনাম ঠিক করেছিলাম সম্ভবত সোমবার দিন। কী লিখব তাও মাথায় ছিল, আকৃতিহীন কুয়াশার কোমল কুণ্ডলীর মতো, যেন মেঘ—বৃষ্টিসম্ভবা, কিছুটা অচিহ্নিত হয়ে। এমন যে, লিখতে বসলে শব্দই তার মর্মের পরশে আমাকে টেনে নিয়ে নিয়ে যাবে অচেনা সেই প্রান্তরে, যেখানে যাব বলে প্রস্তুত হয়ে আছি। সবসময় যেমনটি হয়। এবার বসার জন্য অপেক্ষা শুধু। এরপর বসব বসব করে বৃহস্পতি গড়িয়ে গেল, নানাবিধ জীবন ব্যস্ততায় বসা আর হয়ে উঠল না। শুক্রবার ফজরের নামাজের পর একটু ঘুমিয়ে ছিলাম, ঘুম যখন ভাঙল আধবোজা চোখ নিয়েই মুখোমুখি হলাম নির্দয় একটি শব্দের সম্মুখে—বিদায়। একমাত্র বোনটা চলে যাচ্ছে সুদূর অস্ট্রেলিয়ায়। বহু বছর পর দু-তিন মাসের জন্য বাড়িতে এসেছিল।
আজ তার শেষ দিন। আমি তো জানতাম, তবু বিদায় যেন জানার সাথে সম্পৃক্ত নয়; আয়োজন ও দৃশ্যের ভিতর দিয়ে হামলা চালায় আচানক। এর তীব্র আঘাতে খুব দ্রুত সবকিছু বদলে গেল। অশ্রুর ফোঁটা, বুকের ভেতর অজস্র শব্দের কোলাহল, কেউ কারো মুখের দিকে তাকাতে না পারা। বড় ভাগনে আবদুল্লাহ, তেরো কি চৌদ্দ বছর বয়স, সবাইকে জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে কাঁদছে। বোনটা ছোট ছোট অস্ফুট শব্দ নিয়ে অসহায়ের মতো বিদায় নিচ্ছে এর ওর থেকে। পুরো দৃশ্যটি থেকে আমি ছিটকে বেরিয়ে এলাম। যেন মুখোমুখি হতে চাই না এই শব্দগুলোর। ব্যাগ উঠাই, গেট খুলে দিই, নানা ছুতোয় দূরে দূরে থাকি। একসময় গাড়িটা বেরিয়ে গেল, আর আমরা বেদনায় অভিভূত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম যে যার জায়গায়। মাঝে মাঝে ভাবি, জীবনটা এমন কেন! মৃত্যুর আগেই মুখোমুখি হতে হয় আরও অজস্র বিচ্ছেদবেদনার, ছোট ছোট মৃত্যু যেন এই সব বিদায়ের ক্ষণ!
গতরাতে আমি তার কাছে ক্ষমা চাইলাম। বললাম, আমি ঠিকমতো তোর খোঁজখবর নিতে পারিনি। কোনো সাহায্যই করতে পারিনি। আমাকে মাফ করে দিস। তুই চলে যাবি, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। সে বলল, ভাইয়া, তুমি তো সবসময় আমার খবর নিয়েছ। সাহায্য করেছো। সে কাঁদো কাঁদো হয়ে পড়ল। স্মৃতি আমাদেরকে আলোড়িত করে তুলছে খুব। আম্মার কথা মনে পড়ছে। ছোটবেলার সময়গুলোর কথা। সে চোখের জল ছেড়ে দিয়ে বলল, আমি আমার কষ্ট ব্যাখ্যা করতে পারি না।
বোনকে বিদায় দিয়ে ঘরে ফিরে দেখি নির্জন রুমে আমার ছোট্ট মেয়ে বারীরা বিছানায় উপুড় হয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। পাঁচ বছরের ছোট্ট একটা মানুষকেও বিদায় এমনভাবে আঘাত করে! আমি কোলে নিয়ে বললাম, বাবা, খারাপ লাগছে খুব? সে কান্নার বেগ আরও বাড়িয়ে বলল, ‘ফুফু চলে গেছে!’ ফুফু তাকে অনেক আদর করেছে। ছোট ছোট ভাগনে-ভাগনিদের সাথে অনেক আনন্দে কেটেছে তার এ কয়টা দিন। আহারে জীবন, মায়ার বাঁধন এইসব!
আমরা সাত ভাই এক বোন। মানুষ বলে সাত ভাই চম্পা। কিন্তু আমি ওর নাম দিয়েছি শুকতারা। সবার এত আদরের; কিন্তু কাছে পাইনি তেমন একটা। শৈশবেই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলাম, সেও; আমিও। ছুটিতে মাঝে মাঝে দেখা হতো। রমজানের সময়টা একসাথে কাটানোর সুযোগ পেতাম। বাইরে বাইরে সময়টা দ্রুতই কেটে গেল। আমি স্বপ্ন দেখতাম আমার বোনটির দূরে কোথাও বিয়ে হবে, সবুজ একটি গ্রামে। ওর সুন্দর গোছালো একটা সংসার হবে। আমি মাঝে মাঝে বড় বড় মাছ, কয়েকটি মিষ্টি কুমড়ো, ঘরের আঙিনায় চাষ করা সবুজ শাকসবজি, কলা, পাটালি গুড়, গাভীর দুধ আরও কত কি নিয়ে বেড়াতে যাব। হয়তো ভর দুপুর তখন। আমাকে দেখেই ভাগনে-ভাগনিগুলো উঠোনজুড়ে হইচই করে উঠবে।
বোনটা পরিশ্রান্ত চেহারায় বারান্দায় বেরিয়ে আসবে। সেসময় তার মুখে যে হাসিটি থাকবে, আমি যেন দূর সফরের ক্লান্তি ভুলে যাব নিমিষেই। বুকজুড়ে নেমে আসবে মধুর শীতলতা। ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করবে আম্মা কেমন আছেন? আব্বার শরীরটা ভালো যাচ্ছে তো? আমার রুমটা কি এলোমেলো করে ফেলেছ? ফিরে আসার সময় আঁচলে চোখ মুছবে আর বলবে, বোনটিকে ভুলে যেয়ো না। দ্রুতই ফিরবে আবার। সাথে আম্মাকে নিয়ে আসবে। আমি সান্ত্বনা দিয়ে বেরিয়ে আসব। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাব না। পথের পানে তাকিয়ে থাকা অশ্রুসজল মুখটি সহ্য করা তো ভারী মুশকিল হতো। কিন্তু আমার সমস্ত কল্পনা কল্পনাই রয়ে গেল। আমি পড়ালেখা শেষ করে বাড়িতে ফিরবার আগেই সে চলে গেল, মহাদেশ পেরিয়ে কোন সুদূর অস্ট্রেলিয়ায়। এখন তার সুন্দর গোছালো একটি সংসার হয়েছে।
সচ্ছলতা ও শান্তিতে ভরপুর। অসাধারণ একটি বোনজামাই পেয়েছি আমরা, আলহামদুলিল্লাহ। আমলে আখলাকে, সমঝদারিত্বে, কর্তব্যপরায়ণতায় বড় ভালো মানুষ। পাঁচজন ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখময় একটি জীবনব্যস্ততায় বোনটি আমার সানন্দে প্রবৃত্ত হয়ে আছে। কিন্তু আমার সে স্বপ্নটা? পূরণ তো হয়নি। হওয়া কি জরুরি? আমার স্বপ্নের চেয়ে তো ওর সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যটা, জীবনের আনন্দটা বেশি জরুরি। আমিও তা-ই চেয়েছি। সে সুখী হয়েছে। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি! কিন্তু হৃদয় গহনে আমার স্বপ্নভঙ্গের বেদনাটুকু আছে। আমিও বুঝি এ বেদনা অযথাই, জীবনের কাছে নিতান্ত মূল্যহীন; কিন্তু আমার অনুভবে সে বেদনা আবির ছড়ায় অনুক্ষণ।
ওর মধ্যে আমি দেখতে পাই আম্মার গভীর ছায়া। জীবনের প্রতি অসম্ভব প্রতিজ্ঞ একজন মানুষ। মিশনারি। পাঁচটা বাচ্চাকে লালনপালন করা, ঘরদোর সামলানো, আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর রাখা, সামাজিকতায় অংশগ্রহণ করা। এতসব ব্যস্ততার সামনে সে আপন লক্ষ্যে দু চোখ স্থির রেখে ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাচ্চাদের আমল আখলাকের তরবিয়ত দিয়ে, পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষ করে সংসারটিকে সুন্দর একটি পরিণতি ও পূর্ণতার দিকে নিয়ে যেতে হবে। কর্মমুখর একটি প্রাণোচ্ছল জীবন সাধনে তার ভেতরে আছে অসম্ভব জেদ, উচ্ছ্বাস, প্রাণবন্ততা ও আনন্দ। এতসব কিছুর ভিতর দিয়ে তার আমলের রুটিন আছে। নামাজ কুরআন তেলাওয়াত, মাসনুন জিকির, দোয়া, পড়াশোনা সবকিছু এত নিয়মতান্ত্রিকভাবে সামলে ওঠার জন্য যে প্রাণশক্তি ও প্রতিজ্ঞার দরকার, ঠিক যেন আম্মার মতো। সাংসারিক তুচ্ছতা তাকে স্পর্শ করতে পারে না।
পরনিন্দা, অন্যের বিষয় নিয়ে মেতে থাকা, কে কী বলে ফেলল, এসব নিয়ে কখনো দুঃখ নেই তার। নেই কোনো উন্নাসিকতা। পেছনের কোনো দুঃখ, কারো কোনো আঘাত কিছুই মনে রাখে না। তার জীবনজুড়ে যে অসম্ভব সুন্দর এক কর্মমুখরতা, সেসবের সামনে এসব যেন বিলীন ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সীমাহীন সবর ও সুন্দর সরল একটি মৌনতা দিয়ে সবকিছুকে সে পেরিয়ে যায় আপন জীবনের কাছে। আমার চেয়ে অনেক ছোট হয়েও বিবিধ গুণাবলিতে আমার চেয়ে এগিয়ে গেছে অনেক অনেক দূর।
বোনটাকে কাছে পাই না। ইচ্ছে হলেই দেখতে পারি না। ফোনেও যোগাযোগ হয় কম। সে ব্যস্ত, আমিও ব্যস্ত। দুদণ্ড কথা বলার ফুরসত এখানে সামান্যই। কিন্তু স্মৃতিকাতর হই। গতরাতে কথায় কথায় বলছিলাম, আমরা ভাইবোন তো মূলত একটি দেহই। পৃথিবীতে চলাফেরার সুবিধার জন্যই বুঝি আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আটটি অংশে বিভক্ত করে পাঠিয়েছেন। এ মূলত কথার কথা ছিল না। ছিল গভীর অনুভব ও জীবনবোধেরই শব্দরূপ। আমাদেরই একটা অংশ আমাদের থেকে বহু বহু দূরে, শেষ রাতের নিষ্প্রভ নক্ষত্রের আকাশে জ্বল জ্বল করে জ্বলছে একটি শুকতারা। একা। যাকে আমরা কাছে পাই না। দূর থেকে দেখে যাই শুধু।
মাঝে মাঝে খুবই বিস্মিত হই, মানুষ দেখতে দেখতে কীভাবে বড় হয়ে যায়। কত দ্রুত বদলে যায় পৃথিবী। এই তো সেদিন ও ছোট্ট ছিল। এতটুকুন পিচ্ছি একটা মেয়ে। মাথায় বাবড়িসম ঝাঁকড়া চুল দুলিয়ে বাড়িজুড়ে হইচই করে বেড়ায়। হাসে। খেলে। খুব অল্পতে খুশি হতে পারত। খুব সামান্যতে অভিমানী হয়ে উঠত। গ্রামের পথে পথে ওকে নিয়ে কত ঘুরেছি। কিন্তু একদিনের কথাটি কখনো ভুলতে পারি না। ফজরের পর বললাম এসো আমরা সূর্য দেখে আসি। আমি, ও আর আরও দু-তিনজন পিচ্ছি। উঠোন পেরিয়ে মেঠোপথ ধরে একটু এগোলে বিশাল বড় একটা ধানক্ষেত। এর অদ্ভুত একটা নাম ছিল আন্ধাতালাব।
একটু সহজ করে বললে অন্ধ পুকুর। এর ওপারে আরও কিছু সবজি ক্ষেত আর ঘরবাড়ি পেরিয়ে দিগন্ত। একটু শীতকাল তখন। আকাশ ছিল খুব পরিষ্কার। দিগন্তে গাছপালার মাথার উপর দিয়ে আকাশ আলোকিত করে এত সুন্দর একটা সূর্য উঠেছিল সেদিন। আমরা অভিভূত হয়ে তাকিয়ে রইলাম। সূর্য তো আরও দেখেছি। রোদ তো আরও উঠেছে। কিন্তু সেদিনের সোনারোদটুকু যেন আমাদের হৃদয়ের ভেতর আলগোছে ঢুকে গেছে। চমৎকার সে সকালটিতে মাঠ ও দিগন্ত ভেসে গিয়েছিল গাঢ় সবুজের প্লাবনে। মাঝে মাঝেই আমরা সেদিনটির কথা বলি। বলি মনে পড়ে সে সকালটির কথা? এবং টের পাই একটি লাল সূর্য আকাশপাড়ে জেগে উঠছে নতুন করে। স্মৃতির সে সূর্য তখন রোদ ঝরাতে থাকে আমাদের হৃদয় ও চৈতন্যের উপর।
যাবার আগে বোনটি বলে গেছে ভাইয়া, আমি আমার কষ্ট ব্যাখ্যা করতে পারি না। কিন্তু আমিও কি পেরেছি? আমাদের জীবনজুড়ে এই যে বেদনাগুলো, বিচ্ছেদের তীব্র যাতনারা, এসব কি আসলেই ব্যাখ্যা করা যায়? আমারও তাই মনে হচ্ছে বোন। যায় না আসলে। এসব আমাদের বুকের ভেতর আঁচড় কাটে শুধু। কষ্টের দাগ ফেলে যায় বড় গভীর করে।
- সাবের চৌধুরী
- কথাসাহিত্যিক
Tags : bangla tutorial,bangla current affairs,rgj bangla,how to convert word to pdf bangla,pdf,word to pdf,bangla book pdf,hs bangla mcq pdf,hs bangla saq pdf,bangla word to pdf,ms word to pdf bangla,bangla question pdf,bangla pdf book download,quran shikkha bangla pdf,bangla movie,crate pdf file in bangla,bangla cartoon,how to make pdf file bangla,pdf convert bangla tutorial,bangla book pdf free download,bangla,bangla word file to pdf converter, bangla pdf book download,bangla book pdf free download,pdf,bangla book pdf,bangla,bangla tutorial,bangla current affairs,hs bengali question paper 2022 pdf download,class 11 bengali question 2022 pdf download,how to download bangla book pdf free,r s agarwal gs bangla pdf download exam guruji,r s agarwal general science bangla pdf download,how to convert word to pdf bangla,free download,how to download free pdf bangla and english book,download bangla board boi