ব্রাজিলে ইসলাম: এক করুণ ইতিহাস

ব্রাজিলে ইসলাম: এক করুণ ইতিহাস



১৮৬০ সালে বাগদাদের ইমাম আব্দুর রহমান আফেন্দী ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো সমুদ্র বন্দরে নামেন। এই বন্দরে আসাটা তাঁর পূর্ব-প্ল্যান ছিলো না। সমুদ্রের মধ্যে তাঁর জাহাজ ঝড়ের কবলে পড়ে পথ হারিয়ে ফেলে। পথ হারানো জাহাজ ব্রাজিলের বন্দরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। 

সম্পূর্ন অজানা পরিবেশে মুসলিমদের একটি দল এসেছে। এই বন্দরে কেউ তাদের পরিচিত নেই। এখানকার স্থানীয় মানুষ কেমন সেটা তারা জানে না। তাদেরকে যদি কিডন্যাপ করে সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে যায়, তাদের কিছুই করার নেই। তাদেরকে যদি মেরে ফেলে, তবুও তারা কয়জন মিলে আর কী প্রতিরোধ করবে?

ইমাম আব্দুর রহমান আফেন্দী দেখলেন তাদেরকে দেখে কিছু লোক এগিয়ে আসছে। বিপদগ্রস্ত কাফেলা বুঝতে পারছে না স্থানীয় লোকেরা তাদের সাথে কেমন ব্যবহার করবে। 

স্থানীয় লোকেরা সমুদ্র বন্দরে আশ্রয় নেয়া কাফেলার লোকদের দেখে নিলো। তাদের পরনের কাপড়, দাড়ি, পাগড়ি দেখে তাদের বুঝতে বাকি নেই যে, এই বিপদগ্রস্ত কাফেলার লোকেরা মুসলিম। 

রিও ডি জেনিরোর অধিবাসীরা সালাম দিলো- ‘আসসালামু আলাইকুম’। আব্দুর রহমান আফেন্দীর চক্ষু চড়কগাছ। তিনি যেনো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। এই অদ্ভুত, অজানা জায়গায় এসে যখন দেখতে পেলেন সেখানকার অধিবাসীরা তাঁর মতো একই বিশ্বাস লালন করছে, তখন তাঁর অসম্ভব ভালো লাগা শুরু হলো।

“তোমরা তাহলে মুসলমান?”
“জ্বি, আমরা মুসলমান।”
“এখানে আরো মুসলমান আছে?”
“জ্বি, এখানে আরো মুসলমান আছে।”
আব্দুর রহমান আফেন্দী দেখতে পেলেন যে, এখানের অধিবাসীদের মধ্যে অনেকেই মুসলিম হলেও ইসলামের শেকড় থেকে তারা অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। তারা নামাজ পড়তে পারে না, রোজা রাখতে জানে না, ইসলামের ফরজ বিধান সম্পর্কে তাদের ধারণা স্পষ্ট না। তারা নামাজের সময় হলে হাত তালির মতো শব্দ করে নামাজ পড়ে, নাচে। কয়েকটি ভাঙ্গা ভাঙ্গা আরবি শব্দ তারা জানে। ‘লা ইলাহা...’ বলতে পারে। 

আব্দুর রহমান আফেন্দী কারণ অনুসন্ধান করতে লাগলেন। তারা মুসলিম ঐতিহ্য থেকে কিভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো, কিভাবে তারা ইসলামের প্রাথমিক বিধান ভুলে গেলো সেটা খুঁজতে গিয়ে এক করুণ ইতিহাস চলে এলো। তারা কিভাবে ব্রাজিলে এসেছিলো, সেই ইতিহাস। 

আব্দুর রহমান আফেন্দী স্থানীয় লোকদের সাথে থেকে যাবার মনস্থ করলেন। তিনি বললেন, “তাদের সাথে থাকা, তাদেরকে ইলম শিক্ষাদান আমার জন্য ওয়াজিব। আল্লাহ এজন্যই হয়তো বাগদাদ থেকে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন।”

দীর্ঘ ৬ বছর আব্দুর রহমান আফেন্দী ব্রাজিলের মুসলিমদের মাঝে বসবাস করে তাদেরকে তাদের শিকড়ের সন্ধান দেন। তাদেরকে নামাজ, রোজার মতো প্রাথমিক বিধান শিক্ষা দেন। তারপর ফিরে যান স্বদেশে। ব্রাজিলে ৬ টি বসন্ত কাটিয়ে তাঁর এই বিস্ময়কর ভ্রমণের বর্ণনা নিয়ে একটি বই লিখেন। বইয়ের নাম- ‘ব্রাজিলের সফরনামা’। 

দুই.

বর্তমান সময়ে যারা সভ্য সেজে পৃথিবীর মানুষকে সভ্যতা শেখানোর দায়িত্ব পালন করছে, সেই ইংল্যান্ড, অ্যামেরিকা, পর্তুগাল, স্পেনের অসভ্যতার এক কালো ইতিহাস আছে। তাদের অসভ্যতার ইতিহাসের প্রথম তালিকায় থাকবে- ‘Atlantic Slave Trade’ বা আটলান্টিক মহাসাগরে দাস বাণিজ্য। 

প্রায় ৪০০ বছর ধরে তারা আফ্রিকা থেকে মানুষকে ধরে-বেঁধে নিয়ে যেতো ব্রাজিল, অ্যামেরিকা, ক্যারিবিয়ায়। আফ্রিকার স্বাধীন মানুষ, যারা সেখানে পরিবার নিয়ে তাদের মতো করে বসবাস করছে, তাদেরকে লোহার চেইনে বেঁধে জাহাজে করে নিয়ে যাওয়া হতো শ্রমিক হিশেবে। তবে, পারিশ্রমিকের বিনিময়ে না, দাস হিশেবে। 

এই ধরণের কিডন্যাপিং দাস বাণিজ্য সর্বপ্রথম শুরু করে পর্তুগাল। ব্রাজিলে ছিলো তাদের উপনিবেশ। ১৫২৬ সালে পর্তুগীজরা সর্বপ্রথম ‘ট্রান্স-আটলান্টিক দাস বাণিজ্য’ শুরু করে। তাদের দেখে ইউরোপ-অ্যামেরিকার বাকি সব সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো এই ঘৃণ্য, অমানবিক কাজ করতে থাকে। ৪০০ বছরে ধারণা করা হয় ১ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষকে আফ্রিকা থেকে দাস বানিয়ে তারা নিয়ে যায়। শুধুমাত্র ব্রাজিলেই নিয়ে যাওয়া হয় ৩০ লক্ষের বেশি আফ্রিকান মানুষ। 

আফ্রিকার যেসব অঞ্চল থেকে মানুষ দাস বানিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো, সেসব অঞ্চলের মধ্যে অনেকগুলো ছিলো মুসলিম অধ্যুষিত। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো আফ্রিকার মুসলিমদেরকে দাস বানিয়ে নিয়ে যায় অ্যামেরিকা মহাদেশে। সবচেয়ে বেশি নিয়ে যায় ব্রাজিলে। সেখানে নিয়ে চিনি চাষ করাতো। কড়া নজরদারিতে রাখতো, যাতে তারা মাথাচড়া দিয়ে দাঁড়াতে না পারে। মুসলিমরা তাদের ধর্মচর্চা করতে তো পারতোই না। যদি নামাজ পড়ার সময় ধরা পড়ে, তাহলে তাদেরকে শাস্তি দেয়া হতো। 

আস্তে আস্তে আফ্রিকা থেকে দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ ব্রাজিলের মুসলিমরা তাদের ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলে। নামাজ, রোজাসহ ইবাদাত করতে পারতো না। এক প্রজন্মের পর আরেক প্রজন্মে হারিয়ে যায় তাদের বিশ্বাস, সংস্কৃতি। তারা শুধু জানতো যে, তারা মুসলিম। কিন্তু, ধর্মীয় বিধান পালনের কঠোর বিধি-নিষেধের ফলে স্বাভাবিকভাবে তারা সেগুলো ভুলে যায়। আরবিতে কথা বললে, আরবি নাম রাখলে তাদেরকে মারধর করতো তাদের মনিবরা। সুকৌশলে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করা হয় গোটা মুসলিম সভ্যতা, সংস্কৃতি থেকে। 
তাছাড়া অনেক মিশনারী এসে তাদেরকে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণে প্রলোভন দেখায়, কোনো কোনো মনিব বলপ্রয়োগ করে ব্রাজিলের মুসলিমদের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণে বাধ্য করে। 

আটলান্টিক দাস বাণিজ্য সর্বশেষ বন্ধ হয় ব্রাজিলে। ১৮৩১ সালে ব্রাজিলে নতুন করে দাস নিয়ে আসার প্রথা আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধের নির্দেশ দেয়া হলেও অবৈধভাবে সেটা চলতে থাকে। তাছাড়া মুসলিমদের উপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে, তাদেরকে ধর্মান্তরিত করার প্রয়াসও কয়েক গুণ বেড়ে যায়। 
সবকিছু মিলিয়ে ব্রাজিলে দাসরা একটি বিদ্রোহ করে। ১৮৩৫ সালের সেই বিদ্রোহের নাম ‘মালী বিদ্রোহ’। এই বিদ্রোহ সংগঠিত হয় বাহিয়ায়। এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী মুসলিমদের মধ্যে প্রায় একশো জনকে হত্যা করা হয়। ব্রাজিল থেকে ইসলামের চিহ্ন মুছে দেবার জন্য নানান প্রচেষ্টা চালানো হয়। অনেক মুসলিম সুযোগ পেয়ে আবার আফ্রিকায় ফেরত যান; তাদের পিতৃপুরুষদের দেশে। তবু, ১৯১০ সালের দিকে দেখা যায় ব্রাজিলে প্রায় ১ লক্ষ মুসলিম বসবাস করে। 
বর্তমানে (২০১০ সালের) সরকারি তথ্যমতে ব্রাজিলে প্রায় ৩৫ হাজারের বেশি মুসলিম বসবাস করে। বেসরকারি তথ্যমতে বর্তমানে ব্রাজিলে মুসলিমদের সংখ্যা প্রায় ৪ লক্ষ থেকে ৫ লক্ষ।

লেখা: আরিফুল ইসলাম

বিঃদ্রঃ এটা কতটুকু সত্য ইতিহাস আমি সেই সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নই, তাই প্রিয় গবেষণাধর্মী পাঠক ভাইয়েরা এর সত্যতা যাচাই করে সঠিক  ইতিহাসের মর্মকথা হৃদয়ে সংরক্ষণ করুন


Tags : bangla tutorial,bangla current affairs,rgj bangla,how to convert word to pdf bangla,pdf,word to pdf,bangla book pdf,hs bangla mcq pdf,hs bangla saq pdf,bangla word to pdf,ms word to pdf bangla,bangla question pdf,bangla pdf book download,quran shikkha bangla pdf,bangla movie,crate pdf file in bangla,bangla cartoon,how to make pdf file bangla,pdf convert bangla tutorial,bangla book pdf free download,bangla,bangla word file to pdf converter, bangla pdf book download,bangla book pdf free download,pdf,bangla book pdf,bangla,bangla tutorial,bangla current affairs,hs bengali question paper 2022 pdf download,class 11 bengali question 2022 pdf download,how to download bangla book pdf free,r s agarwal gs bangla pdf download exam guruji,r s agarwal general science bangla pdf download,how to convert word to pdf bangla,free download,how to download free pdf bangla and english book,download bangla board boi

Next Post Previous Post