সমুদ্র ভ্রমণের অভিজ্ঞতা প্রবন্ধ রচনা | সমুদ্রসৈকতে একটি বিকেল
প্রাকৃতিক রহস্যময় সৃষ্টিগুলোর মধ্যে সমুদ্র অন্যতম। বিশাল সমুদ্রের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে অপার রহস্য ও বিস্ময়। এই সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে বিস্তৃত বালুকারাশি, নুড়ির প্রবাল আর ঢেউয়ের দোলায়। অপরূপ সৌন্দর্যের বিশ্বের সর্ববৃহৎ সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার এবং অপরটি হলো সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার বিস্ময়কর স্থান কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত।
তাই ভ্রমণপিপাসু ও সৌন্দর্যপ্রেমিক মানুষের কাছে কুয়াকাটা সৈকতই প্রথম পছন্দ। পটুয়াখালী জেলায় অবস্থিত ১৮ লীলাভূমি নদীমাতৃক বাংলাদেশের পুরো দক্ষিণ উপকূল জুড়ে সমুদ্রসৈকত থাকলেও দুটি সৈকত বিখ্যাত। এর একটি হলো কিলোমিটার দীর্ঘ নৈসর্গিক সৌন্দর্যের এ পাদভূমি সারাবছরই পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়।
সমুদ্র ভ্রমণের অভিজ্ঞতা
উপন্যাসে সমুদ্রতট সম্পর্কে পড়ে শিক্ষকদের রোমাঞ্চিত বর্ণনা শোনার পর সমুদ্রের বিশালতা সম্পর্কে আমার কিশোর মনে কল্পনায় সমুদ্রসৈকত : আমার সৌন্দর্য পিপাসু দুরন্ত মনে ছোটবেলা থেকেই সমুদ্র দর্শনের প্রবল ইচ্ছা ছিল। গল্প, কবিতা, নানারকম কল্পনা সারাক্ষণ দোলা দিয়ে যেত।
আমার কল্পনার চক্ষু সারাক্ষণ খুঁজে বেড়াত মহাসমুদ্রের দীর্ঘ সৈকত, আর বিস্তীর্ণ বেলাভূমি, চোরাবালির ভয়ঙ্কর ফাদ, দূর সমুদ্রের গর্জন, নীল সমুদ্রের হাতছানি আরও কত কী! এসবই আমার মনে কল্পনার ফানুস উড়িয়ে আমাকে সমুদ্র ভ্রমণে উৎসাহিত করেছিল।
কুয়াকাটা যাত্রা ঃ তখন আমি যশোর জিলা স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। স্কুল থেকে বার্ষিক ভ্রমণের জন্য আমাদের শিক্ষকগণ কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। আমি সেই সুযোগ পেয়ে ধন্য হলাম। নির্ধারিত দিনে স্কুলের প্রায় সকল শিক্ষক ও ছাত্র যাত্রা শুরু করলাম কুয়াকাটার উদ্দেশ্যে। মৃদু বাতাসে সোনালি বিকেলে মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে আমাদের গাড়ি হেলে-দুলে যশোর, খুলনা হয়ে পটুয়াখালীর দিকে এগিয়ে চলল।
হালকা ঠান্ডাকে উপেক্ষা করে ভ্রমণের আনন্দে এবং চাঁদনি রাতের সৌন্দর্যে আমরা বাসের মধ্যে মুগ্ধ মনে পথ চলতে থাকি। মাঝে মাঝে বন্ধুবান্ধব ও শিক্ষকদের রোমান্টিক ও হারানো দিনের গান আমাদের রাত জাগাকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে। তারপর দীর্ঘ যাত্রা শেষে আমরা বহু আকাঙ্ক্ষিত কুয়াকাটা পৌঁছে সমুদ্রসৈকত দেখার আনন্দ উপভোগ করি ।
সমুদ্রসৈকতে একটি বিকেল ঃ বিকেলে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে পড়ন্ত রোদে সৈকতের পথে হাঁটতে বের হলাম। এ সময় চারপাশের ছবি তুলে আর শামুক-ঝিনুক কুড়িয়ে আমরা কিছুটা সময় পার করলাম। বিকেলে বালুর উপর চিকচিক রোদ এবং দর্শণার্থীদের বৈচিত্র্য আমার হৃদয়ে শিহরণ জাগিয়ে গেল।
এমন সময় পূর্ব আকাশে সাতটি রঙের অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়ে বিশাল রংধনু আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে যেন আমাদের বরণ করে নিল । তখন আমার মন গেয়ে উঠলো— 'কী সুন্দর মালা আজি পরিয়াছ গলে।' কুয়াকাটার সূর্যাস্তের অপূর্ব দৃশ্য একনজর দেখার জন্য প্রচুর দর্শনার্থীর সমাগম হয়।
এ সময় চারিদিকে আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। পশ্চিমাকাশে রক্তিম আভায় নীল সমুদ্র আর সূর্যের লুকোচুরি খেলার দৃশ্য যে-কারো জন্যই স্মরণীয় মুহূর্ত। এ সময়ের দৃশ্যাবলি ভাষা দিয়ে প্রকাশ করা দুঃসাধ্য। বিশাল থালার মতো লাল সূর্য চোখের সামনে সমুদ্রবক্ষে হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্যের চেয়ে সুন্দর কিছু যেন আর নেই ।
কুয়াকাটা থেকে প্রস্থান : সূর্যোদয়, দ্বিপ্রহর, বিকাল, সূর্যাস্ত সবই উপভোগ করার পর আমাদের বিদায়ক্ষণ উপস্থিত হলো। আমরা সবাই ফিরে যাওয়ার জন্য তৈরি হলাম। এমন অপরূপ দৃশ্য অবলোকন আর তা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য মন একই সঙ্গে আনন্দে ও বিষাদে দোল খাচ্ছিল। আমরা বাসে উঠে নিজ নিজ আসনে বসে পড়লাম। আর জানালায় হাত নেড়ে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতকে বিদায় জানিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। সঙ্গে থাকলো কুয়াকাটার স্মৃতি।
উপসংহার :
স্মৃতি মানুষকে তাড়া করে ফেরে। আর সেই স্মৃতি যদি হয় আনন্দ আর বেদনামিশ্রিত তাহলে তা হৃদয়ে স্থায়ী দাগ কেটে যায়। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত মাত্র একদিনে আমার মনে যে গভীর ভাবাবেগ সৃষ্টি করে তা সত্যিই বিস্ময়কর। সমুদ্র তার নান্দনিক সৌন্দর্য দিয়ে মানুষের মনকে সব সংকীর্ণতা ও কুসংস্কার থেকে পরিশুদ্ধ করে কর্মক্লান্ত হৃদয়ে প্রশান্তি এনে দেয়।
সমুদ্র মানুষকে উদারতা, কোমলতা ও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার শিক্ষা দেয়। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত ভ্রমণ আমার স্মৃতিতে, আমার হৃদয়ে অমলিন হয়ে থাকবে।