আমার প্রিয় লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় | আমার প্রিয় মনীষী রচনা
ভূমিকা : আমার প্রিয় লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু কেন? তাঁর সাহিত্যে মনুষ্যত্বের মহিমাই উচ্চরিত হয়েছে প্রথম ধ্বনিতে হয়েছে লাঞ্ছিত মানবাত্মার মহাক্রন্দন। বাংলার সাহিত্য-গগনে যে ক'জন কথাশিল্পী বিশেষভাবে বাঙালি পাঠকের হৃদয়ের নিভৃত নিকেতনে রাজাসন পেয়ে রাজকীয় জৌলুশে চিরঅমর হয়ে আছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁদের মধ্যমণি।
উপন্যাসে ঠাঁই পেল 'যাদের বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না; যারা সমাজের অবহেলিত, চির-পতিত এবং চির অপাঙক্তেয় শরতের হাতে নির্মিত হলো চির-বঞ্চিতদের অপূর্ব-জীবন-বেদ। তিনি বাংলা সাহিত্যের অপরাজেয় কথাশিল্পী। শরৎ ভাই আমাদের আত্মার আত্মীয়, একান্ত আপনজন। আমার প্রিয় গ্রন্থকার।
আমার প্রিয় লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
জন্ম ও শিক্ষা ঃ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৭৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার অন্তর্গত দেবনন্দপুর গ্রামে এর অতি সাধারণ ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
হুগলির দেবনন্দপুরে জন্ম হলেও তাঁর শৈশব কেটেছে ভাগলপুরে মাতুলালয়ে এফ.এ ক্লাসে (উচ্চ-মাধ্যামিক) পড়তে পড়তে অর্থাভাবে তিনি পড়া বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন এবং এরপর জীবিকা নির্বাহের জন্যে অর্থ উপার্জনের প্রয়োজনে কর্মে মনোনিবেশ করেন।
তবে তাঁর প্রকৃতিতে কিছু বাউন্ডেলে ভাব ছিল। তাই তিনি বেশ কিছু দিন সন্ন্যাসী-বেশে বহু জায়গায় ঘোরাফেরা করে সময় অতিবাহিত করেছিলেন। এ ধরনের ঘোরাফেরার বদৌলতে তিনি বহু বিচিত্র জ্ঞান ও অভিজ্ঞাতার অধিকারী হতে পেরেছিলেন। এর কিছুদিন পর অর্থোপার্জনের উদ্দেশ্যে তিনি রেঙ্গুনের পথে পাড়ি জমান
সাহিত্যক্ষেত্রে শরৎচন্দ্রের অবদান ঃ রবীন্দ্র-প্রতিভা-সূর্য তখন মধ্য-গগনে। সেই উজ্জ্বল আলোকবিভায় যে-কোনো প্রতিভাই তখন ম্লান। সাহিত্যিক-স্বীকৃতি তখন যথার্থই দুঃসাধ্য। তখনই সাহিত্য-দিগন্তে এক নতুন প্রতিভা-নক্ষত্রের উদয় হলো। সেই প্রতিভার নাম শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি হলেন বাংলার জনচিত্তজয়ী কথাশিল্পী। চৌদ্দ বছর বয়সে 'কাশীনাথ' লেখা হলেও 'কুন্তলীন পুরস্কার প্রাপ্ত 'মন্দির গল্পটিই তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্প।
১৯০৭ সালে ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত 'বড়দিদি-ই সাহিত্য-ক্ষেত্রে তাঁকে দিল স্থায়ী আসন। বৃহত্তর পাঠক-অভিনন্দনে তিনি কৃতার্থ হলেন। ফিরে এলেন কলকাতায়। আত্মনিয়োগ করলেন সাহিত্যচর্চায়
সামাজিক অনাচার : পুরুষ-শাসিত সমাজে নারীজাতিকে তেমন উচ্চমর্যাদা দেওয়া হতো না। নারীরা পদে পদে নানাপ্রকার নিগ্রহের শিকার হতো। নারীদের এমনিতর অসহায় অবস্থা দর্শন করে মানবপ্রেমিক রাজা রামমোহন রায় ভারতের তদানীন্তন বড়লাট লর্ড বেন্টিংক-এর সহায়তায় আইনের মাধ্যমে জঘন্য সতীদাহ প্রথা রহিত করেন।
এর কিছুদিন পর মনীষী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা-বিবাহ প্রবর্তন করে সমাজে নারীর মর্যাদা অনেক ওপরে তুলে ধরেন। নারীসমাজের দুর্গতি ছাড়াও অন্যদিকে ছিল বর্ণবৈষম্যকে হাতিয়ার করে, তথাকথিত নিম্নশ্রেণির অসহায় মানুষগুলোর ওপর ব্রাহ্মণ-সমাজের হৃদয়হীন দৌরাত্ম্য তদুপরি জমিদার শ্রেণির অকথ্য অত্যাচার বাংলা সামাজিক জীবনকে করেছিল কালিমালিপ্ত।
সেদিন অসহায় মানবাত্মার কাতর ক্রন্দনে বাংলার আকাশ-বাতাস ব্যথাতুর হয়ে উঠেছিল। শরৎচন্দ্র বাংলার সেই সামাজিক জীবনের বেদনার ক্ষতস্থানে অশ্রুবর্ষণ করে ক্ষতস্থানে বুলিয়ে দিলেন সমবেদনার শীতল স্পর্শ।
শরৎচন্দ্রের উপন্যাস ঃ উপন্যাসেই শরৎ-প্রতিভার যথার্থ বিকাশ। সংসারের পরিচিত সাধারণ নরনারীই তাঁর উপন্যাসের পাত্রপাত্রী। তাদেরই সুখ-দুঃখ, বিরহ-বেদনা, দ্বন্দ্ব-মিলন, ঈর্ষা-প্রেমের অশ্রুসিক্ত কাহিনি তিনি লিখে গেছেন। ঘরের কথাকে এমন মর্মস্পর্শী আবেগ সহানুভূতি মথিত ভাষায় শরৎচন্দ্রের আগে আর কেউ লেখন নি। দুঃখী, ব্যথিতের জন্য তিনি উজাড় করে দিলেন তাঁর হৃদয় বেদনা-মথিত ভালোবাসা।
সেখানকার যত করুণাবরি সমস্তই বর্ষিত হলো এই অবহেলিত নিরূপায় মানুষের জন্য। তাঁর উপন্যাসের কতকগুলো আয়তনে ক্ষুদ্র, কতকগুলো বৃহৎ। তাঁর ‘কাশীনাথ’, নিষ্কৃতি’, ‘বিন্দুর ছেলে', ‘রামের সুমতি, 'বড়দিদি', 'মেজদিদি', বৈকুণ্ঠের উইল', 'পরিণীতা', 'দেবদাস', 'চন্দ্রনাথ', 'দত্তা', ‘পণ্ডিতমশাই' প্রভৃতি ক্ষুদ্রায়তন উপন্যাসে গার্হস্থ্য জীবনের নানা মান-অভিমান, ঈর্ষা-দ্বন্দ্ব, স্নেহ-প্রীতির মর্মস্পর্শী চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
কোথাও মাতৃত্বের হাহাকার, কোথাও নিকষিত হেম প্রেমের রসমাধুর্য, কোথাও ব্যর্থ প্রেমের দীর্ঘশ্বাস, সকরুণ বিলাপ, কোথাও ভুল বুঝাবুঝির অন্তর্বেদনা, কোথাও প্রীতিপ্রেমের পুণ্য বাঁধনে সেই অন্তরচারী বেদনার নিরসন।
আবার 'পল্লীসমাজ', 'বামুনের মেয়ে', 'দেনা 'পাওনা' ইত্যাদি উপন্যাসে পল্লির তুচ্ছতা, সঙ্কীর্ণতা, দলাদলি, নীচতার রুঢ়-রুক্ষ বাস্তব ছবি এঁকেছেন। 'শ্রীকান্ত', 'চরিত্রহীন, উপন্যাসে ঘোষণা করেছেন সমাজ-অস্বীকৃত প্রেমের মহিমা। 'গৃহদাহ' আধুনিক জটিল মনস্তত্ত্ব-নির্ভর নরনারীর করুণ জীবন- আলেখ্য।
‘পথের দাবী', 'শেষ প্রশ্ন উপন্যাসে হয়েছে আধুনিক সমাজ-বিবর্তনের চিন্তাভাবনার প্রতিফলন। কিন্তু সর্বত্রই সামাজিক নির্যাতন, সংস্কারপঙ্গু বিধিনিষেধের হৃদয়হীনভাবে বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ ।
শরৎচন্দ্রের ছোটগল্প ঃ শরৎ প্রতিভা মূলত উপন্যাস বা বড় গল্প আশ্রয় করেই সৃষ্টিমুখর হয়েছে। তাঁর প্রতিভা ছোটোগল্প রচনার অনুকূল ছিল না। তবু যে সামান্য কটি ছোটোগল্প তিনি লিখেছেন সেখানেও তাঁর অনায়াস সিদ্ধি। তাঁর রচিত 'মহেশ', অভাগীর স্বর্গ, ‘একাদশী বৈরাগী বাংলা ছোটোগল্পের সম্পদ।
তিনি ছিলেন সমাজ-সচেতন শিল্পী। সমাজে ভাঙন, বিকৃতি পচনশীলতাকে তিনি যেমন নিখুঁতভাবে চিত্রিত করেছেন, তেমনি নিপীড়িত সর্বহারা মানুষের জন্য করেছেন অশ্রু বিসর্জন।
বলিষ্ঠ কন্ঠে উচ্চারণ করেছেন মানবতার বাণী। 'মহেশ' সমাজ-নিষ্পেষণের এক নির্মম, বিশ্বস্ত দলিল । গফুর নিপীড়িত দরিদ্র অসহায় কৃষক সমাজের প্রতিনিধি। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ এসে এই গল্পে ভিড় করেছে। শেষ পর্যন্ত হৃদয়হীন সমাজ- প্রতিনিধিদের অত্যাচারে রাত্রির অন্ধাকারে নিঃসহায় গফুরকে গভীর বেদনা, হাহাকার নিয়ে মেয়ে আমিনার হাত ধরে চটকলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে হয়।
এ তো শুধু রুধিরাশ্রুসিক্ত গভীর মর্মান্তিক কাহিনিই নয়, এর মধ্য দিয়ে নতুন ফুলবেড়ের যুগের পদধ্বনির আভাসও দিয়েছেন মরমি লেখক। দুলে বাগদি ঘরের, স্বামী পরিত্যক্ত বন্ধু অভাগী সতীত্বের জোরে মাথায় সিঁদুর, পায়ে আলতা মেখে স্বামী-পুত্র রেখে স্বর্গে যাওয়ার ঐকান্তিক কামনা নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল, কিন্তু জন্মদুঃখিনী অভাগীর সৎকারের জন্যে সমাজের নিষ্ঠুর বিধানে সামান্য কাঠও দুর্লভ হয়ে যায়।
মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের অভিজ্ঞতায় অভাগী-পুত্র কাঙালি সমাজের প্রকৃত চেহারাটা প্রত্যক্ষ করে ‘বুড়া হইয়া গিয়াছিল। ‘একাদশী বৈরাগী'-তে সমাজব্রাত্য কুসীদজীবী একাদশীর মধ্যেও সত্যের মহিমা উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। জন্মসূত্রেই মানুষ মহৎ হয় না, মনুষ্যত্ববোধের জাগরণেই মানুষ মহৎ মানুষ বৃহৎ ।
শরৎ-সাহিত্যের মূল্যায়ন : যে দুর্লভ গুণে মহাকালের দরবারে শরৎ-সাহিত্যের অমরতার প্রার্থনা, তা হলো তার গভীর মানবতাবোধ। তিনিই প্রথম নিপীড়িত লাঞ্ছিত বাঞ্চিত মানুষের ব্যথা-বেদনাকে সাহিত্যের বিষয় করেছেন। সমাজ-অনুশাসন কবলিত ম্লান মুখে ভাষা দিয়েছেন। মানবতার পাদপীঠেই শিল্পীর নত-নম্র শ্রদ্ধার অর্ঘ্য।
তিনি ব্যথাহত কণ্ঠে পাঠকের কাছে কবুল করে গেলেন, 'সংসারে যারা শুধু দিলে, পেলে না কিছুই- যারা বঞ্চিত, যারা দুর্বল, উৎপীড়িত- মানুষ যাদের চোখের জলের কোনো হিসাব নিলে না, নিরুপায় দুঃখময় জীবনে যারা কোনোদিন ভেবেই পেল না সমস্ত থেকেও কেন তাদের কিছুতেই অধিকার নেই— এদের বেদনাই দিলে আমার মুখ খুলে, এরাই পাঠালো আমাকে মানুষের কাছে মানুষের নালিশ জানাতে।'
তাই বাস্তবের রূঢ়-রুক্ষ-অসুন্দরের মধ্যেই তিনি সুন্দরের আরাধনা করেছেন। পঙ্কের মধ্যেই তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন পঙ্কজের অমলিন সৌন্দর্য।
শরৎ-সাহিত্যে নারী-চরিত্র এক বিশেষ মর্যাদায় হয়েছে অনন্যা। নারী এখানে চিরন্তন কল্যাণী সত্তায় মহিমাময়ী। অন্নদাদিদি, রাজলক্ষ্মী, অভয়া, সাবিত্রী, কিরণময়ী, বিজলীচন্দ্রমুখী সমাজের কলঙ্কতিলক পরেও নারীত্বের মহিমায় আজও ভাস্বর।
কিশোর চরিত্র অঙ্কনেও লেখক সমান দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর ইন্দ্রনাথ, শ্রীকান্ত, কেষ্ট, রাম, অমূল্য, নরেন অবিস্মরণীয় চরিত্র। উপসংহার : শুধু বিষয় বা চরিত্র অঙ্কনেই যে শরৎচন্দ্র দক্ষশিল্পী তা নয়, তিনি দুঃখী মানুষের অন্তহীন দুঃখের কাহিনি রচনা করতে গিয়ে যে অনবদ্য ভাষা ব্যবহার করেছেন তারও বিকল্প নেই।
মানুষের কাছে মানুষের নালিশ জানাতেই তিনি কলম ধরেছিলেন। যথার্থই ‘দেশের মৃত্তিকা থেকে নিল যারে হরি, দেশের হৃদয় তারে রাখিয়াছে ধরি।' মৃত্যু-শাসনেও তিনি মৃত্যুঞ্জয়, প্রেমের আসনেই তাঁর অমর প্রতিষ্ঠা।