গ্রাম বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনুচ্ছেদ | পল্লী প্রকৃতি অনুচ্ছেদ
পল্লী উন্নয়ন: হরিতে-হিরণে, সবুজে-শ্যামলে, সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা আমাদের এই দেশ বাংলাদেশ- যার মূলভিত্তি ছায়া-সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলো' ।
প্রায় বিরানব্বই হাজার গ্রাম (বর্তমান পরিসংখ্যান অনুযায়ী) নিয়ে গঠিত এই দেশের শতকরা ৭৭ জন লোক পল্লিগ্রামে বাস করে। কৃষিনির্ভর এই দেশের উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়, যদি না পল্লির উন্নয়ন হয়। পল্লির উন্নতি মানে দেশের উন্নতি ।
গ্রাম বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনুচ্ছেদ
পল্লি উন্নয়ন কী? ঃ পল্লি উন্নয়ন বলতে উৎপাদন বৃদ্ধি, সম্পদের সুষম বণ্টন ও ক্ষমতায়নের মাধ্যমে গ্রামীণ দরিদ্র জনগণের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য এক পরিকল্পিত পরিবর্তনকে বুঝায় ।
আজকের বাংলাদেশে পল্লি উন্নয়নের নির্দিষ্ট লক্ষ্য হচ্ছে গ্রামীণ বিত্তহীনদের, বিশেষ করে পশ্চাৎপদ মহিলা ও শিশুদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম করা এবং সে নিয়ন্ত্রণের ফলশ্রুতি হিসেবে প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধার যথাযথ বণ্টন।
পল্লি উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা বা জাতীয় উন্নতিতে পল্লির গুরুত্ব ঃ আমাদের জাতীয় অর্থনীতির মূল উৎস পল্লি। পল্লি উন্নয়ন ব্যতীত দেশের সর্বমুখী বা সর্বজনীন কল্যাণ সম্ভব নয়। পল্লির অবস্থান ও উন্নয়নের ওপর বাংলাদেশের অস্তিত্ব নির্ভরশীল। তাই পল্লিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে হবে।
আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্যে যে-সব উপকরণ প্রয়োজন, পল্লিতে তার কোনো অভাব নেই, অভাব শুধু যুগোপযোগী শিক্ষা, আদর্শ ও কর্মপ্রেরণার। পল্লি সবসময়েই উন্নয়নযোগ্য। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে পল্লির সামগ্রিক উন্নয়ন সাধন সম্ভব ।
পল্লি উন্নয়ন পরিকল্পনা ঃ পল্লির ভাগ্য উন্নয়নের মাঝেই সার্বিক উন্নয়ন নির্ভরশীল একথা অনস্বীকার্য। কিন্তু এ উন্নয়ন কাজে অগ্রসর হতে হলে প্রতিটি ক্ষেত্রেই পল্লিবাসীকে আত্মনির্ভরশীল হতে হবে। সকল সময় সরকারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকলে চলবে না। আত্মশক্তির ওপর ভরসা করেই আমাদের পল্লি-উন্নয়ন কাজে অগ্রসর হতে হবে। উন্নয়নের প্রতিটি ব্যবস্থা যাতে ধীরে ধীরে উন্নতির পথে অগ্রসর হতে পারে, তার জন্যে সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
পল্লি উন্নয়নের উপায় :
১। শিক্ষার ব্যবস্থা : গ্রামের মানুষের জন্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। পল্লির অনগ্রসরতার মূল কারণ অশিক্ষা ও কুশিক্ষা । ২। স্বাস্থ্য উন্নয়ন : পল্লির ৭৫% শিশু অপুষ্টির শিকার। বছরে ত্রিশ হাজারেরও বেশি শিশু অন্ধত্বের কবলে পড়ে, লাখ লাখ শিশু মারা যায় ডায়ারিয়া ও নিউমোনিয়ার আক্রমণে। অধিকাংশ গ্রামে রয়েছে বিশুদ্ধ পানীয় জলের সমস্যা।
সাম্প্রতিক কালে গ্রামে গ্রামে আর্সেনিক দূষণ গ্রামবাসীদের স্বাস্থ্যরক্ষায় মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। উন্নত স্বাস্থ্য শক্তিশালী জাতি গঠনে সহায়ক- এ সত্যকে সামনে রেখে পল্লির জনস্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ রাখতে হবে এবং এর জন্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
৩। কৃষি উন্নয়ন : বাংলাদেশের পল্লিজীবন কৃষিভিত্তিক। বর্তমান যুগের আধুনিক স্বয়ংক্রিয় কৃষিব্যবস্থা প্রচলনের মাধ্যমে আমাদের দেশে কৃষকদের অধিক খাদ্যশস্য উৎপাদনের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রবর্তনের মাধ্যমে কৃষির উন্নয়ন করতে হবে ।
৪। কুটিরশিল্পের উন্নয়ন : কুটিরশিল্পের মাধ্যমে গ্রামের বেকারদের কর্মসংস্থান করতে হবে। কুটিরশিল্প ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সাহায্যের হাত সরকারকে প্রসারিত করতে হবে। কারণ, গ্রামবাসীর অগ্রগতিই দেশের অগ্রগতি।
৫। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঃ যাতায়াত ও মালামাল পরিবহনের জন্যে রাস্তাগুলো সংস্কার সাধন ও পর্যাপ্ত নতুন রাস্তা নির্মাণ করে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করতে হবে।
পল্লি উন্নয়নের সমস্যা : পল্লি উন্নয়ন প্রয়াস সম্পর্কিত অতীত অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণ থেকে বড় ধরনের বেশ কিছু সমস্যাকে চিহ্নিত করা যায়, যেগুলো উন্নয়ন প্রয়াসের সফল সম্পাদনকে ব্যাহত করে আসছে।
এসব সমস্যা হচ্ছে- ১। পল্লি উন্নয়ন সংস্থাসমূহের অস্থায়িত্ব, ২। অযোগ্য ও দুর্নীতিপরায়ণ নেতৃত্ব, ৩। কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক স্থানীয় সরকারগুলোকে অসহযোগিতা, ৪ । একটা সুবিন্যস্ত পল্লি উন্নয়ন নীতিমালার অভাব, ৫। পল্লি উন্নয়ন প্রকল্প থেকে উদ্ভূত সুযোগ-সুবিধার অসম বণ্টন, ৬। প্রাকৃতিক ও লব্ধ সম্পদের সীমাবদ্ধতা, ৭। পল্লি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও পরিকল্পনায় আধিপত্য এবং অসহায়ক এক গ্রামীণ সমাজ ।
একবিংশ শতাব্দীর পল্লি উন্নয়ন চিন্তা : বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদসমূহ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে বিপর্যয়ের সম্মুখীন। এ দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠী বিশ্বের দরিদ্র দেশসমূহের মধ্যে দরিদ্রতম এবং বেশিরভাগ জনসংখ্যা মূলত প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। এর ফলে অপরিকল্পিত এবং মাত্রাধিক্য ব্যবহারের কারণে প্রাকৃতিক সম্পদসমূহ ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ এবং শস্য উৎপাদন এ দেশের কৃষির অন্যতম একক অবলম্বন। এর জন্য মাটি এবং ভূমির ব্যাপক ব্যবহার হয়ে থাকে। শস্য উৎপাদনের জন্য মাটির উর্বরতা কিংবা উৎপাদনশীলতা একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যার উন্নয়নের মধ্য দিয়ে কৃষির ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভব।
আর স্বয়ংসম্পূর্ণ কৃষিব্যবস্থার ওপরই নির্ভর করছে গ্রামীণ উন্নয়ন। এজন্য একবিংশ শতাব্দীর পল্লি উন্নয়ন চিন্তাভবনায় কৃষিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে মাটির উপাদান, এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ, সংরক্ষণের প্রতি জোর দেয়া হচ্ছে ।
উপসংহার ঃ
দেশের পঙ্গু অর্থনীতিকে সজীব ও জীবন্ত করে তুলতে হলে গ্রামকে সজীব করে তুলতে হবে। 'গ্রামই দেশের প্রাণ। এটা ভুলে গেলে চলবে না। ড. লুৎফর রহমান বলেছেন- ‘জাতিকে বড় করতে হলে পল্লির মানুষকে প্রথমে জাগাতে হবে।' গ্রামের উন্নতি ও দেশের উন্নতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
আশা করা যায়, অচিরে আমাদের সরকার ও সচেতন দেশবাসীর সক্রিয় সহযোগিতায় গ্রামগুলোকে আমরা 'সোনার গ্রাম' হিসেবে দেখার সুযোগ পাব।