দেশ ভ্রমণে শিক্ষা ও আনন্দ প্রবন্ধ রচনা | শিক্ষার অঙ্গরূপে দেশ ভ্রমণ
“হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগরে অনেক ঘুরেছি আমি।” মানুষ চির যাযাবর। মানুষের রক্তে রয়েছে ভ্রমণের নেশা। অজানাকে জানার অদেখাকে দেখার কৌতূহল মানুষের চিরন্তন। বিশাল এই পৃথিবীর চারিদিকে কত কী দেখার, জানার রয়েছে, কত রহস্য রয়েছে লুকিয়ে।
সেই অপরিচয়ের দুস্তর মহাসমুদ্রের অদৃশ্য তরঙ্গ প্রতিনিয়ত আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। সেই অজানাকে জানবার জন্যে আমাদের অসীম আগ্রহ, অনন্ত উৎকণ্ঠা। এই দূর্নিবার আকর্ষণে আমরা রুদ্ধ দুয়ার খুলে বের হয়ে পড়ি অজানার সন্ধানে ।
দেশে দেশে কত না নগর রাজধানী/মানুষের কত কীর্তি, কত নদী-গিরি-সিন্ধু-মরুভূমি, কত না অজানা জীব, কত না অপরিচিত তরু রয়ে গেল অগোচরে।
দেশ ভ্রমণে শিক্ষা ও আনন্দ প্রবন্ধ
শিক্ষার অঙ্গরূপে দেশ ভ্রমণ ঃ দেশ ভ্রমণ আমাদের মনে অনাবিল আনন্দ দেয়, একঘেয়েমি দূর করে। এর সাথে সাথে নানান বিষয়ে শিক্ষাও দেয়। আমরা স্কুলে ভূগোল, ইতিহাস পড়ে পুঁথিগত কিছু বিদ্যা আয়ত্ত করি ঠিকই কিন্তু সেই জ্ঞান ঠিক পরিপূর্ণ নয়। কারণ পৃথিবী মানচিত্রের কতকগুলো রেখা নয়, বহু মানুষের কলরব মুখরিত সজীব সুন্দর বৈচিত্র্যময় এক ভূখণ্ড।
এই ভূখণ্ডকে জানবার জন্য প্রয়োজন দেশ ভ্রমণ। ইতিহাস ও ভূগোলের বাইরে অবাধ উন্মুক্ত খোলা আকাশের নিচে জীবন্ত দেশটি দেখে, তার অধিবাসীদের প্রত্যক্ষ স্পর্শ লাভ করে, তাদের জীবনধারা সম্পর্কে আমরা যে জ্ঞান লাভ করি, সেই জ্ঞানই প্রকৃত জ্ঞান।
হৃদয়ের প্রসারতা ও মনের গতি আনে ভ্রমণ। বদ্ধঘরের কোণে থাকতে থাকতে এবং একই কাজ করতে করতে মানুষের মনে একঘেয়েমি আসে। তখন কোনো কাজে মন বসে না, মন হাঁপিয়ে ওঠে। বদ্ধঘরের দুয়ার ঠেলে মানুষ বের হয়ে পড়ে মুক্তির আনন্দে।
বহু মানুষের পদচিহ্ন অঙ্কিত তীর্থে তীর্থে ভ্রমণ করে, অজানা কাহিনী শ্রবণ করে সে জানতে পারে নিজের দেশকে। পাহাড়-পর্বত, নদী, গিরি, অরণ্যের অনির্বচনীয় সৌন্দর্য মানুষের মনের প্রসারতা বাড়ায়। ‘চরৈবেতি চরৈবেতি' চলাই জীবন, জীবনের আরেক নাম চলা। যে জীবন চলতে জানে না, সে জীবন বদ্ধ জলাশয়ের মতো।
ভ্রমণ আমাদের দেয় গতি, এই গতির আনন্দে মানুষ উষর মরু, উত্তাল সমুদ্রে পাড়ি দেয়। দুর্লভ গিরিশৃঙ্গ অতিক্রম করে অতীশ দীপঙ্কর তিব্বতে যান বৌদ্ধধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির সম্যক জ্ঞান অর্জনের জন্য সুদূর চীন থেকে ফা-হিয়েন, হিউয়েন সাঙ এসেছিলেন ভারতবর্ষে। অজানা দেশ জয়ের আনন্দে কলম্বাস জীবন বাজি রেখে পাড়ি দিয়েছিলেন।
ভাস্কো-দ্য-গামা, কলম্বাস, মার্কোপোলো প্রমুখ বিখ্যাত বিখ্যাত পর্যটকগণের দুঃসাহসিক পর্যটনের ফলে আজ পৃথিবীর বহু দুর্গম দেশ-দেশান্তর মানুষের জ্ঞানের পরিধির মধ্যে এসে গেছে। তাঁদের দুর্বার দেশ পর্যটন ও আবিষ্কার করার ফলে পৃথিবীর কত নামহীন গিরি-নদী, কত অজানা অরণ্য, মরুভূমি, কত তুষারাচ্ছন্ন মেরু প্রদেশ আবিষ্কৃত হয়ে মানুষের জ্ঞান ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে।
দেশ ভ্রমণ ও জাতীয় সংহতি এবং সৌভ্রাতৃত্ববোধ : বর্তমানে দেশভ্রমণ শিক্ষার একটি অপরিহার্য অঙ্গরূপে স্বীকৃত। দেশ ভ্রমণের মাধ্যমে দেশের ভৌগোলিক পরিচিতি, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সেখানকার নরনারীদের জীবনযাত্রার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে পরিচিত হওয়ার ফলে মনের প্রসারতা যেমন বাড়ে তেমনি পারস্পরিক আদান-প্রদানের ফলে একটা অখণ্ড সার্বভৌমতার মনোভাব সৃষ্টি হয়। এর ফলে আমরা যে একই ভূখণ্ডের অধিবাসী, পরস্পর ভাই ভাই এই সংস্কৃতি বোধেরও জন্ম হয়।
প্রকৃত দেশভ্রমণ সৌভ্রাতৃত্ববোধের জন্ম দেয় তা স্বামী বিবেকানন্দের বাণী থেকেও জানা যায়। ‘সমগ্র ভারতবাসী আমার ভাই' হিমালয় থেকে কন্যা কুমারিকা ভ্রমণের পরে তিনি একথা বলেছিলেন
উপসংহার ঃ
ভ্রমণেই আনন্দ, ভ্রমণেই মুক্তি। মুক্তির আনন্দেই দেশ-বিদেশের বহু মানুষ বেরিয়ে পড়ে শত বিপদ মাথায় নিয়ে । বন্ধঘরের কোণে যে মন হাঁপিয়ে ওঠে, প্রকৃতির উন্মুখ প্রান্তরে সে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়। শুধু যে মনের আনন্দ হয় তা নয়, স্বাস্থ্যেরও উন্নতি ঘটে।
নতুন করে কাজে উদ্দীপনা পায়, আর প্রকৃতির অফুরন্ত জ্ঞানের ভাণ্ডার থেকে জ্ঞান আহরণ করে মানুষ নিজেকে সমৃদ্ধ করে। বর্তমানে আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকার ভ্রমণ শিল্পকে আরোও উন্নত করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।
ভ্রমণার্থীদের সুবিধার জন্য ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছেন, রাস্তাঘাটের সংস্কার করেছেন, যাত্রীনিবাস নির্মাণ করে দিয়েছেন, পানীয় জলের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন স্থানীয় দেশ-বিদেশের ভ্রমণার্থীরা কোনো অসুবিধায় পড়লে তাদের বিভিন্নভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।