বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ - বইটি কেন পড়বেন? | শরিফুল হাসান - Batashe Bristir Ghran

বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণঃ তিন দশকের আত্মচিৎকার

১৯৭৫ সালের আগস্টের এক বিষণ্ণ সকাল। সকাল থেকেই আকাশে মেঘের আস্তরণে পৃথিবী অভিমানের ঝিরিঝিরি বর্ষণে ক্লান্ত, ক্লান্তির শেষমেশে অভিমান অঝোর ধারায় ধরণীতে গড়িয়ে পড়ছে বৃষ্টি রূপে। আর সেই অভিমানের বর্ষণের দিকে স্কুল ঘর থেকে এক নজরে তাকিয়ে আছে সাড়ে আট কি নয় বছর বয়সী অ্যালবার্ট পিন্টো! জন্মসূত্রে বাংলাদেশের হলেও একাত্তরের যুদ্ধে পিন্টো এখন ভারতবর্ষের এক শহরতলীর বাসিন্দা। একাত্তরের নৃশংসতার সময়ে বাবা, মা আর ভাইয়ের হাত ধরে পিন্টো পাড়ি জমায় হিন্দুস্থানে। কিন্তু, ভাগ্যের চক্রজালে এখন সে অনাথ হিসেবে বড় হচ্ছে এক ব্যাপ্টিস্ট চার্চে। 
  • বইঃ বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ
  • লেখকঃ শরিফুল হাসান - Shariful Hasan
  • প্রকাশনীঃ অন্যধারা
  • প্রচ্ছদঃ তানিয়া সুলতানা
  • নামলিপিঃ সালমান সাকিব জিশান
  • মুদ্রিত মূল্যঃ ৬৪০/- 

নিজের বাবা, মা আর ভাইকে খুঁজতে হন্য হয়ে আছে পিন্টো। অথচ, নিজের পরিচয়ের এই অভিযানে তার হাতে এক টুকরো কাগজ ছাড়া আর কিছুই নেই। যাতে লেখা তিন অক্ষরের একটি নাম। যেটাই হয়তো তার পরিচয়ের মোক্ষম সূত্র। কিন্তু, নিয়তি পিন্টোকে আবারো ফিরিয়ে আনে এক নতুন রূপে এই বাংলাদেশে!
নতুন সেই জীবনে এসে পিন্টো জড়িয়ে পরে ঢাকাস্থ এক হিন্দুবাড়ির সাথে। পেশায় স্বর্ণকার এই সরকার বাড়িতে এসে পিন্টো ভুলে যায় সমস্ত পুরোনো ক্ষত। 

যেখানে মায়ের রঙে রঙ্গিন হয়ে আসে মা, ভাই আর বোনদের আদর। আর ভালবাসায় ভরিয়ে দেওয়া প্রেয়সীর রূপে হাজির হয় সুষ্মিতা সাহা। কিন্তু নতুন এই রূপ কি ব্যাপ্টিস্ট চার্চের অ্যালবার্ট পিন্টোকে ভুলতে পারবে! সরকার বাড়ির সবাই আদৌ কি নামেই বা চিনে ওপার থেকে আসা অ্যালবার্ট পিন্টোকে! সুখের এই যাত্রাপথে পিন্টো কি তার পূর্বপুরুষকে খুঁজে পাবে! ঘটনার ধ্রুমজালে পিন্টোকে বহু আকাঙ্খার সরকার বাড়িও ছাড়তে হয়, ঠাঁই নিতে হয় ব্রক্ষপুত্রের কিনারে ময়মনসিংহের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ময়মনসিংহ পিন্টোর ভাগ্যের মোড় ঘুরে যায় নতুন আশায়!

ময়মনসিংহে অ্যালবার্ট পিন্টো ভালবাসার ব্যাথা লুকিয়ে সন্তপর্ণে রাখতে চাইলেও আবারো ধরা দেয় ভালবাসার এক সুখের নিয়তির কাছে। কিন্তু সে তো শেকড়ের সন্ধান চায়, চায় স্থিরতা। বাকি সব সাধারণ মানুষের মতো সাধারণ জীবন। যেখানে তাকে অভিনয় করতে হবে না। সেই জীবন কী শুধুই বাতাসে ভেসে বেড়ানো এক কল্পনা। কিন্তু একদিন সকালের লোমহর্ষক ঘটনা সবকিছুর মোড় ঘুরে যায়। ব্রক্ষপুত্রের পাশে একটি গাছের নিচে হেলান দিয়ে পাওয়া যায় পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া একজন মানুষ! দু চোখ গলে বেরিয়ে আসছে, মাংস পুড়ে হাড্ডির সাথে লেগে হাড়ের সাদা অংশ দেখা যাচ্ছে। পকেটে একটুকরো কাগজে তিন অক্ষরের নাম! কার লাশ এটা? কে এমন হত্যার শিকার হলো?

অনুভূতির বিকিরণঃ

বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ লেখক শরীফুল হাসানের ২০২২ এর বইমেলায় প্রকাশিত উপন্যাস। লেখক উপন্যাসটি সম্পর্কে বলেছেন,
 "একক উপন্যাস হিসেবে 'বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ' আমার সবচেয়ে বড় লেখা। এক লাখ দশ হাজার শব্দের আয়োজন। এরচেয়ে বড় লেখা বাংলা সাহিত্যে ছিল, আছে এবং এখনও অনেক লেখা হচ্ছে এবং হবে। তবে আমার জন্য প্রথম। এই লেখাটা লিখতে গিয়ে অনুভব করেছি, এরকম একটা গল্প দীর্ঘদিন আমার মধ্যে জমা ছিল। সময়মত বেরিয়ে এসেছে।  আরও বছর দশেক আগে লিখলে হয়তো ঠিক এভাবে লেখা হতো না।"

প্রায় ৪১৫ পেইজের এই উপন্যাসটি বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান তিনটি ঘটনার প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতির সারাংশের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের অনুভূতিকে নিয়ে এগিয়ে যায়। হ্যা, সাধারণ মানুষের অনুভূতি উঠে এসেছে উপন্যাসের প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে।
১) বঙ্গবন্ধুর খুন আর পঁচাত্তর পরবর্তী অবস্থা
২) জেনারেল শাসন এবং স্বৈরতন্ত্রের বিকাশ
৩) আধুনিক আমলাতান্ত্রিক প্রশাসন
প্রথমে ব্রিটিশ শাসনের ২০০ বছরের বলয় ভাঙ্গার পরে পাকিস্তান আমলের প্রায় ২৪ বছরের নিষ্পেষিত শাসনের পরে এই বাংলার মানুষ আদৌ কি চেয়েছে? মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীতে পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর খুনের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে এক নতুন মোড় আসে। আর প্রতিটি নতুন মোড় প্রভাবিত করেছে শ্রেনীবিন্যাস, সংখ্যালঘু থেকে শুরু করে গরিষ্ঠদের। এবং ঠিক এই ব্যাপারগুলোয় বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণে লেখক খুব দারুণ করে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। জেনারেল শাসনে গণতান্ত্রিক অধিকার নিধন অথবা চিরায়ত মুখোশে ধর্মকে সাধারণ মানুষের অনুভূতিতে ব্যবহার করা, বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণের প্রতি প্লটে প্লটে তার ছোঁয়া পাওয়া গিয়েছে।

উপন্যাসে বহুরূপের প্রোটাগনিস্ট অ্যালবার্ট পিন্টো ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোর মধ্যে বিশ্বনাথ চরিত্রটি অন্যতম। তৎকালীন মার্শাল ল চলাকালীন এই চরিত্রটি আসলে প্রথা বা শৃঙ্খল ভাঙ্গার আওয়াজের মতোই উপন্যাসে ধ্বনিত হয়েছে। যার দীপ্ত কন্ঠে উচ্চারিত হয়, "আমি অন্যরকম একটা কিছু করতে চাই"।

আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ইমরান আহমেদের মাধ্যমে আসলে ছবি ভেসে উঠে প্রতিটি বিপ্লবের স্রোতে মগ্ন থেকেও ছিটকে যাওয়ার দলটিকে। অথচ, কথা ছিল সাম্যের দরজা দিয়েই এ বঙ্গ দেশে শ্রমের, অধিকারের মুক্তি আসবে। আমরা সবাই একটা সময় ভীষণ রকমের ইমরান আহমেদ হয়ে ছিলাম। হয়তো এখনো আমি আছি। আর ভবিষ্যতে এমন সাম্যের ভাবনার জলাঞ্জলি দিয়েই হয়ত আরো হাজার ইমরান আহমেদ ইউথোপিয়ান ড্রিম ছেড়ে সিঙ্গাপুর গিয়ে গ্রোসারির ব্যবসা করবে!

পরের প্রসঙ্গে বলতে যাওয়ার আগে এরিস্টটলের সেই কথাটি টানছি, "গণতন্ত্র মূর্খদের শাসনব্যবস্থা"। যেটা ভেসে উঠে উপন্যাসে বিশ্বনাথের মামা সাংবাদিক মানিকচন্দ্রের কথায়। সাধারণ মানুষ আসলে কি পছন্দ করে? জেনারেল শাসন, বাক-স্বাধীনতা কতটা ঝড় বয়ে নিয়ে যায় এদের প্রতিদিনকার যাপনে। তারা বাক-স্বাধীনতা যতটুকু চায় তার চেয়েও বেশি চায় শান্তি, কর্মসংস্থান আর মাথার উপরে নিরাপত্তার ছাদ!

প্রতিটি চরিত্র আর ঘটনার ক্রমবিন্যাস পাঠককে ধরে রাখতে বেশ ভাল ভূমিকাই রাখবে। আর সমস্ত গল্পগাঁথার খুঁটি হিসেবে অ্যালবার্ট পিন্টো পুরো উপন্যাস জুড়ে চালিয়ে গেছে তার প্রচণ্ড প্রতাপ। এই শহরের প্রতিটি ইট পাথরে প্রতিদিন অজস্র পিন্টোর অনুভূতি ক্রুশবিদ্ধ হয়। ভালবাসা এসেও হারিয়ে যায় অজানা গন্তব্যে।
"পৃথিবীতে ভালোবাসা যখন দেখানোর তখনি দেখাতে হয়। না হলে সময় এত বদমাশ যে, দ্বিতীয়বার আর সুযোগ দেয়না কখনো। "

প্রায় ৪১৫ পেইজের বইটি আমি এক বসায় শেষ করে উঠেছি বা আমাকে টেনে রেখেছিল শেষ করে উঠতে। বিশেষ ভাল লাগার দিক, আমি সবসময় পঁচাত্তর পরবর্তী সময় এবং নব্বই দশকে সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক ভাবনা এই বিষয়গুলো নিয়ে পড়তে ভালবাসি। এই বইটি বাংলাদেশের সে সময়কার প্রেক্ষাপট খুব সুন্দর ভাবে এসেছে। বিশেষ করে প্রচ্ছদ নামলিপির মতোই স্নিগ্ধ! বানান আর টুকিটাকি কিছু অসংগতি যা ছিল সেগুলো পড়তে তেমন চোখে লাগেনি আমার। আর লেখকের সাহিত্য! প্রতিটি লাইনের বুনট এত অনবদ্য। আমার এই গড়নের বই পড়তে গিয়ে মনে হয় একটা মানুষ চিৎকার করে তার প্রতিটি লাইনে ভেতরের প্রকৃত ভালবাসাকে জানান দিচ্ছে। অথচ, আমরা তাকে গথবাঁধা জনরায় সীমাবদ্ধ করে দিয়েই আসছি এতকাল! ঠিক অমলকান্তির মতোই। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছেন,
"আমরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি সে-সব কিছু হতে চায়নি।

সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল!
ক্ষান্তবর্ষণ কাক-ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর,
জাম আর জামরুলের পাতায়
যা নাকি অল্প-একটু হাসির মতন লেগে থাকে।"

মুলতঃ লেখক শরীফুল হাসান ঠিক এই সময়ে এসে 'যেখানে রোদেরা ঘুমায়' থেকে শুরু করে 'বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণে' শরীফুল হাসান যেন সাহিত্যের অগ্রযাত্রার দারুণ পরিস্ফুটন। একটি ক্ল্যাসিক ঘরানার ফ্যান্টাসি থেকে আবহমান বাংলার যাপনের কথা, অনুভুতির বিকিকিনি এ যেন কথাসাহিত্যের সাথে কল্পকথার এক দারুণ মেলবন্ধন। সাম্ভালা পড়ে আমি লেখককে জাদুগর নামে সম্মোধন করি। আমার জাদুগরের জাদুর থলিতে এভাবেই একে একে খুঁজে পাওয়া যায় মেঘ বিষাদের গল্প, ছায়া সময়, রূপকুমারী ও স্বপ্নকুহক, ঋভুর মত জাদুর কিছু ছোঁয়া। আহমেদ করিমের সাহিত্যের উপাখ্যানের এই যাত্রাপথ মহাকাব্যে উজাড় হোক!

Author information 

শরীফুল হাসানের জন্ম
Shafif Hasan - author 
লেখক শরীফুল হাসানের জন্ম ময়মনসিংহ শহরে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করেছেন তিনি। বর্তমানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। থৃলার সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ থেকে লেখালেখির জগতে পদার্পন। অনুবাদ দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও পরবর্তিতে লিখেছেন সাম্ভালা টৃলোজি (সাম্ভালা, সাম্ভালা দ্বিতীয় যাত্রা, সাম্ভালা শেষ যাত্রা), ঋভু, আঁধারের যাত্রী এবং কালি ও কলম ২০১৬ শিশু ও কিশোর সাহিত্যে পুরষ্কারপ্রাপ্ত অদ্ভূতুড়ে বইঘর। এছাড়া বেশ কিছু গল্পসঙ্কলনে প্রকাশিত হয়েছে তার একাধিক ছোটগল্প।

Tags : bangla tutorial,bangla current affairs,rgj bangla,how to convert word to pdf bangla,pdf,word to pdf,bangla book pdf,hs bangla mcq pdf,hs bangla saq pdf,bangla word to pdf,ms word to pdf bangla,bangla question pdf,bangla pdf book download,quran shikkha bangla pdf,bangla movie,crate pdf file in bangla,bangla cartoon,how to make pdf file bangla,pdf convert bangla tutorial,bangla book pdf free download,bangla,bangla word file to pdf converter, bangla pdf book download,bangla book pdf free download,pdf,bangla book pdf,bangla,bangla tutorial,bangla current affairs,hs bengali question paper 2022 pdf download,class 11 bengali question 2022 pdf download,how to download bangla book pdf free,r s agarwal gs bangla pdf download exam guruji,r s agarwal general science bangla pdf download,how to convert word to pdf bangla,free download,how to download free pdf bangla and english book,download bangla board boi

Next Post Previous Post